২৫ আগস্ট ২০২১, বুধবার, ২:৫৩

২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়

করোনার ধাক্কায় কমেছে ৪১ হাজার কোটি টাকা

বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব

চলমান করোনাভাইরাসের প্রভাবে রাজস্ব আদায় কমেছে ৪১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সংশোধিত রাজস্বের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সেই তুলনায় বছর শেষে মোটা অঙ্কের এ অর্থ আদায় কম হয়েছে।

মূলত কয়েক দফা লকডাউন, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকাণ্ড ও শিল্পোৎপাদন বন্ধ থাকায় আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জিডিপিতে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সমন্বয় সভায় রাজস্ব আদায়ের এ চিত্র তুলে ধরা হয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

আরও জানা যায়, ওই সভায় রাজস্ব পরিস্থিতিসহ কয়েকটি ইস্যু আলোচনায় উঠে আসে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিম। আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনার কারণে সারা দেশে লকডাউনসহ অন্যান্য বিধিনিষেধ ছিল।

এরপরও রাজস্ব অর্জনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ শুল্ক ও কর বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ৮৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ অর্জন সম্ভব হয়েছে। যার প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অর্থনীতির এ সংকটকালীন রাজস্ব আদায়ের এ ধারাকে তিনি ইতিবাচক হিসাবে উল্লেখ করেন। পাশাপাশি তিনি চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এনবিআরের সব সদস্য, কমিশনার অব কাস্টমস, কর কমিশনার এবং গবেষণা ও পরিসংখ্যান মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়েছেন।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, করোনার সময়েও রাজস্ব আদায় ভালো হয়েছে। কারণ এ সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবিরতা ছিল। আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম কম হয়েছে। ফলে রাজস্ব আদায়ে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরপরও সার্বিকভাবে আদায় পরিস্থিতি ভালো হয়েছে। তবে জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত বিশ্বের সবচেয়ে কম হচ্ছে বাংলাদেশে। এটি বাড়াতে হবে। সবাই জানে যে কর ও ভ্যাট অনেকে ফাঁকি দিচ্ছে। এসব বন্ধ করতে হলে আরও মনিটরিং বাড়াতে হবে।

সূত্রমতে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের বৈঠকে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সেখানে দেখানো হয়, গত অর্থবছরের (২০২০-২১) সংশোধিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। সেখানে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় কমেছে ৪১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। এ আদায়ের হার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ কম।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এই রাজস্ব কমে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ ধরা হয় করোনাভাইরাসের মহামারি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হয় কোভিড-১৯। পরবর্তী অর্থবছর ২০২০-২১ পুরোটায় এ মহামারির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি মন্থর ছিল, যা এখনো বিদ্যমান। তবে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার কিছুটা কমে আসে। ওই সময় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পথে এসেছিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে এই সময়ে রাজস্ব আদায়ের গতিও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ফের করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় এপ্রিল থেকে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বাধ্য হয়ে ১৪ এপ্রিল থেকে পুনরায় লকডাউনের ঘোষণা করে। এতে সব ধরনের পরিবহণ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পর্যটনকেন্দ্র, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। এমন একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গত অর্থবছরের আড়াই মাস কেটে যায়। ফলে ওই অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে বড় ধরনের আঘাত পড়ে রাজস্ব আদায়ের ওপর। এতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এছাড়া এ সময় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বিনিয়োগ না থাকায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও ব্যাপক হারে কমে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কাস্টমস শুল্কের ওপর।

গত অর্থবছরে কাস্টমস শুল্ক খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩৭ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। বিপরীতে আদায় হয়েছে ৮২ দশমিক ০৭ শতাংশ। অর্থাৎ ৭২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৬ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা আদায় সম্ভব হয়নি।

এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র থেকে বড় ধরনের অর্থ আদায় হয় ভ্যাট খাতে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসায় এ খাত থেকে আদায় পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট খাতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। বছর শেষে আদায় হয়েছে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ৮৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১ লাখ ২ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। করোনা মহামারির কারণে এ খাতে আদায় কমছে ১৩ হাজার ৮৮ কোটি টাকা।

এছাড়া সংশোধিত আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৭৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৬৫ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার ৮৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত অর্জন সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে টাকার অঙ্কে আদায় কম হয়েছে ৯ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় হ্রাস পাওয়ার আরও একটি কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকাকে। কারণ সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি স্থবিরতার কারণে এ খাত থেকে আদায় অনেক কমেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/457357/