২৪ আগস্ট ২০২১, মঙ্গলবার, ১:০১

ভিওআইপির চোরাকারবার রোধে সব পদ্ধতি বিকল

গত ৩১ মে বন্ধ হয়েছে সিমবক্স ডিটেকশন সিস্টেম

সাত বছর আগে ২০১৪ সালে ঈদুল আজহার দিন বিদেশ থেকে দেশে বৈধ পথে ১৬ কোটি মিনিট টেলিফোন কল আসে। আর এবারের ঈদুল আজহার দিন ও তার আগে-পরের মোট তিন দিনে গড়ে প্রতিদিন কল এসেছে দুই কোটি ৯৬ লাখ ৪৭ হাজার ৭১৬ মিনিট। আর ঈদুল ফিতরের সময় তিন দিনে গড়ে প্রতিদিন দেশে আসা বৈদেশিক কলের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৭৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩২ মিনিট। গত জুলাই মাসে প্রতিদিন ছিল গড়ে এক কোটি ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫৯৬ মিনিট।

এই হিসাবে ঈদের বিশেষ সময়েও দেশে বিদেশ থেকে আসা ফোন কলের পরিমাণ প্রত্যাশা অনুসারে বাড়েনি। অথচ আগের বছরগুলোতে ঈদের সময় বিদেশ থেকে আসা ফোন কলের পরিমাণ ছিল সাধারণ দিনগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক কলের এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, দেশে ভিওআইপির (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) অবৈধ কারবার বন্ধ হয়নি। বরং লুটপাট আরো বেড়েছে। ছোটখাটো নয়, বড় কোনো দুষ্টচক্র এর সঙ্গে যুক্ত। কারণ ভিওআইপির অবৈধ কারবারে এখন আফ্রিকার দেশগুলোর মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যবহার করা হচ্ছে টেলিটক ও বিটিসিএলের মতো সরকারি মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানকে। ছোটখাটো কোনো চক্রের এই ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। (ওভার দ্য টপ) বা হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার, ইমো, স্কাইপ—এসব ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের কারণে প্রচলিত পথে আন্তর্জাতিক ভয়েস কল আসা কমে গেছে—এমন প্রচারের সুযোগে চক্রটি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদির মাধ্যমে কথা বলতে হলে উভয় প্রান্তেই স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় গতির ইন্টারনেট সংযোগও থাকতে হবে, কিন্তু দেশে স্মার্টফোনের ব্যবহার এখনো অনেক কম—৩৫ শতাংশের নিচে। ইন্টারনেট সব এলাকায় সহজলভ্য নয়। এ কারণে প্রচলিত ভিওআইপি কলের চাহিদা এখনো ব্যাপক। মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলো থেকে প্রবাসীরা এখনো ভিওআইপি কলের ওপর নির্ভরশীল।

সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে প্রবাসী একজন বাংলাদেশি জানান, সেখানে শপিং মলগুলোতে বাংলাদেশের জন্য প্রতি ১০ রিয়ালে ১০০ মিনিট রেটে ভিওআইপি কলিং কার্ড বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু এই বাস্তবতার পরেও ভিওআইপির চোরাচক্রের লুটপাট বন্ধে বিটিআরসি অনেকটাই নিরুপায়। অবৈধ এই কারবার বন্ধে মোবাইল ফোন অপারেটররা ২০১০ সালের মে মাসে বিটিআরসিতে যে সিমবক্স ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপন করে দিয়েছিল, তা গত ৩১ মে বন্ধ হয়ে গেছে। অপারেটররা আর এই সিস্টেম চালু রাখার জন্য টাকা খরচ করতে রাজি নয়। তা ছাড়া যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই পর্যবেক্ষণব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, সেটিও সন্দেহমুক্ত ছিল না।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, ২০১০ সালের দিকে সিমবক্স ডিটেকশন সিস্টেম ছাড়াও সিডিআর অ্যানালাইজার সিস্টেমও (সিএএস) স্থাপন করা হয়, কিন্তু ঢালাওভাবে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটরের লাইসেন্স দেওয়ার পর ওই ব্যবস্থা অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ ছাড়া গেটওয়ে অপারেটরদের মাধ্যমে আসা আন্তর্জাতিক কলের সঠিক হিসাব পাওয়ার জন্যও কেন্দ্রীয়ভাবে যুগোপযোগী ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি পর্যবেক্ষণব্যবস্থা গড়ে তোলাার প্রয়োজন বোধ করে বিটিআরসি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের মে মাসে ‘ইন্টারন্যাশনাল কল ভলিউম অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইললিগ্যাল ভিওআইপি প্রটেকশন সিস্টেম’ নামের বিশেষায়িত সেবা ক্রয়ের জন্য এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) বা আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের আবেদন আহ্বান করা হয়। এতে সাড়া দেয় ১৩টি প্রতিষ্ঠান, কিন্তু তার আগেই আন্তর্জাতিক কল রেট কমিয়ে দেওয়া এবং এসব কলের নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব আইজিডাব্লিউ অপারেটরদের ফোরাম ‘আইওএফ’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ওই উদ্যোগ সফল হয়নি। ২০১৪ সালের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক কল পর্যবেক্ষণে সেন্ট্রলাইজড মনিটরিং সিস্টেম (সিএমএস) বা কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি সেবা চালুরও পরিকল্পনা নেয় বিটিআরসি নেয়, কিন্তু সে পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হয়নি।

বর্তমানে মোবাইল ফোন অপারেটরদের এসআর বা সেলফ রেগুলেটরি ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো গ্রাহকের সিমের মাধ্যমে অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক কলের পর্যবেক্ষণ কিছুটা চালু আছে। কয়েক বছর আগে ‘আইওএফ’ পরীক্ষামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান ল্যাট্রো সার্ভিস ইনকরপোরেশনের একটি পর্যবেক্ষণব্যবস্থা চালু করেছিল। সে ব্যবস্থার মাধ্যমে কোথায় ভিওআইপির অবৈধ কারবার চলছে, তা শনাক্ত করা যেত, কিন্তু এটিও ব্যয়বহুল বলে পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সংগতি রেখে আইজিডাব্লিউ অপারেটরদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ সক্ষমতাও তৈরি হয়নি।

এসব সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণের জন্য বিটিআরসি সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে নিজেদের অর্থায়নে একটি পর্যবেক্ষণব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব পাঠিয়েছে।

এদিকে মোবাইল ফোন অপারেটরদের কার্যক্রম তদারকির জন্য বিটিআরসি গত ২ আগস্ট কানাডাভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান টিকেসি টেলিকমের সঙ্গে টেলিকম মনিটরিং সিস্টেম ক্রয়সংক্রান্ত একটি চুক্তি করেছে।

বিটিআরসির পাক্ষে বলা হচ্ছে, এ সিস্টেমটি বাস্তবায়িত হলে মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং রিপোর্টিংপ্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব তথ্য বাস্তব সময়ে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। এতে ভয়েস ও ডাটা ট্রাফিক, নেটওয়ার্ক ব্যবহার এবং মান সম্পর্কিত তথ্য সর্বোপরি বিটিআরসির প্রাপ্য রাজস্ব সম্পর্কে নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। ফলে বিটিআরসির নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে এবং সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ ব্যবস্থা আরো দক্ষ এবং দ্রুত হবে। শহর এলাকার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চল, দ্বীপ, হাওর-বাঁওড়, উপকূলীয় অঞ্চল ও দুর্গম এলাকার টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের প্রকৃত অবস্থা তাৎক্ষণিক যাচাই করা সম্ভব হবে। অপারেটরদের নেটওয়ার্কের লাইভ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে নেটওয়ার্কের সেবার মান আরো সুচারুভাবে যাচাই করা যাবে এবং গ্রাহক সেবার প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে, কিন্তুও এর মাধ্যমে ভিওআইপির অবৈধ কারবার বন্ধ করা যাবে কি না, সে সম্পর্কে বিটিআরসির কর্মকর্তারা নিশ্চিত নন।

এদিকে সর্বশেষ গত ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসি ও র‌্যাব ভিওআইপির অবৈধ কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। ওই অভিযানে রাজধানী ঢাকার নিউ মার্কেট, তুরাগ ও শাহআলী থানা এলাকা থেকে ভিওআইপির অবৈধ কারবারে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ১৯টি সিমবক্স ডিভাইস, ৪১৬টি জিএসএম অ্যান্টেনা, তিন হাজার ৪০০টি টেলিটক সিম, সাত মিনি কম্পিউটারসহ অন্য ভিওওআইপিসামগ্রী, কিন্তু এই চক্রের মূল হোতাদের খোঁজ নিতে আগ্রহ দেখায়নি বিটিআরসি।

জানা যায়, গত ২৩ ও ২৪ মার্চ টেলিটকের নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার (এনওসি) এবং রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের প্রধান কার্যালয় সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করে বিটিআরসির পরিদর্শক দল। পরিদর্শনে যেসব তথ্য মেলে তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভিওআইপির অবৈধ কারবারের সঙ্গে টেলিটকের কর্মকর্তরা জড়িত। তাঁদের এই পরিদর্শন প্রতিবেদন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তী কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের গড়িমসিতে বিস্মিত বিটিআরসির কর্মকর্তারা।

এদিকে কালের কণ্ঠকে দেওয়া বিটিআরসিরর তথ্য অনুসারে, গত বছর দেশে বৈদেশিক কল আসে প্রতিদিন গড়ে দুই কোটি ৩২ লাখ ৭০ হাজার ৮৫৬ মিনিট। আর চলতি বছর গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত কল এসেছে প্রতিদিন গড়ে দুই কোটি ৩৮ লাখ ৬২ হাজার ৪৪৯ মিনিট। এসব কলের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন আইজিডাব্লিউ অপারেটর বিটিসিএলের মাধ্যমে এসেছে প্রতিদিন গড়ে ৮১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৪০ মিনিট। বাকি কল এসেছে বেসরকারি আইজিডাব্লিউ অপারেটরদের ফোরাম আইওএফের মাধ্যমে। আইওএফের দাবি, এর বাইরেও প্রতিদিন তিন কোটি মিনিট কল আসছে চোরাপথে।

এই তথ্য বিশ্লেষণেও জানা যায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর দেশে আসা আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ কিছুটা বেশি এবং ওটিটির ব্যবহার বৃদ্ধির দাবির সঙ্গে বিষয়টি সংগতিপূর্ণ নয়।

আন্তর্জাতিক কল কমে যাওয়া এবং ভিওআইপির অবৈধ কারবারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ বিষয়ে বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অপারেশনস বিভাগের কমিশনার প্রকৌশলী মো. মহিউদ্দন আহমেদ গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ওটিটির ব্যবহারের কারণে আন্তর্জাতিক কল কিছুটা কমে যেতে পারে। ভিওআইপির অবৈধ কারবারের কারণেও এটা হতে পারে। এ বিষয়ে বিটিআরসির কোনো শিথিলতা নেই। করোনার অতিমারি এবং লকডাউনের কারণে বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মুভমেন্ট স্বাভাবিকভাবেই কম ছিল, কিন্তু বিটিআরসির এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/08/24/1066373