২৪ আগস্ট ২০২১, মঙ্গলবার, ১২:৫৯

আর কতদিন বন্ধ থাকবে শিক্ষাঙ্গন?

গত বছর মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ২২ দফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয়েছে। ফলে সর্বশেষ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৫৩২ দিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দরজা বন্ধ। এ বন্ধাবস্থা আর কতদিন চলবে, কেউ তা ঠিক করে বলতে পারে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বাজার, রাস্তাঘাটে স্বাভাবিকতা বিরাজ করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন অস্বাভাবিকই থেকে যাচ্ছে। বিশ্বের ১৪টি দেশে এ ধরনের অস্বাভাবিকতা প্রদর্শন করা হচ্ছে, যেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অন্যান্য দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটানা এতদিন বন্ধ থাকেনি। আমাদের দেশে গত বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাস পরিস্থিতি স্কুল খোলার মতো ছিল; তারপরও খোলা হয়নি। ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, সুবিধাজনক সময় এলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে এবং ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনার কথাও বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি আছে, করোনার সংক্রমণ কমলেই প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হবে।

এত দীর্ঘদিন বন্ধের পর প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার যেসব প্রস্তুতি দরকার, সেই প্রস্তুতি প্রতিষ্ঠানগুলোর আছে কী? প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া মানে ব্যাপক প্রস্তুতির ব্যাপার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান, অবকাঠামো, শিক্ষার্থী ও শ্রেণিসংখ্যার ভিত্তিতে প্রস্তুতি নিতে হবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সে রকম প্রস্তুতি পুরো ব্যবস্থাপনায় নেই। করোনা সংক্রমণের হার বর্তমানে ২০ শতাংশের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে নামলে প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া যেতে পারে। কদিন আগেও এ হার ছিল ৩০ শতাংশ। সংক্রমণের হার সামনে রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখ কতটা যুক্তিযুক্ত, সেটি এখন ভাবার বিষয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্বাভাবিকতা দেখানো কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না; যেখানে সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর প্রচেষ্টা বা প্রক্রিয়া আছে। আগামী নভেম্বরে এসএসসি ও ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সেটি করতে হলে সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দিলে পরীক্ষা গ্রহণ করা কতটা সম্ভব হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

শিক্ষায় ক্ষতির একটি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। তারা বলেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে ভবিষ্যতে আয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীপ্রতি ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১৮০ মার্কিন ডলার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটির ফলে বাংলাদেশের মতো দেশে ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের অভিশাপ শিক্ষাক্ষেত্রকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। সামর্থ্যবান ও শহুরে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষা কিছুটা চালিয়ে নিলেও দরিদ্রশ্রেণি এ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। যেমনটি ঘটেছে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। এখানে একটি বিষয় হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু দারিদ্র্যের কারণে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা যায়নি, বিষয়টি তা নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো আর দরিদ্র নয়। তারা যা প্রদর্শন করছেন, সেটি হচ্ছে ‘ডিজিটাল্লি ইল্লিটারেসি’। এটাও তাদের জন্য কোনো বিষয় ছিল না; কারণ তারা মেধাবী। ইচ্ছা করলেই ডিজিটালি তারা ‘হাইলি অ্যাডুকেটেড হতে পারতেন’; কিন্তু কেন যে বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছেন বুঝতে কষ্ট হচ্ছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীই দরিদ্র নয়। তাছাড়া তাদের তো আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো উচ্চবেতনে পড়তে হচ্ছে না; মাত্র ২০-৩০ টাকা বেতন। দুপক্ষই ইচ্ছে করলেই অনেকটা ডিজিটালি পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারত। সেটি না করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন ডিজিটালি কাজটা শুরু করে দিল, তখন সেটি বন্ধ করে দেওয়া হলো। এটি কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। ২০২১ সালের মার্চে ইউনিসেফ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি ১৪৭টি দেশের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে বলেছে-২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে বিশ্বের আর ১৩টি দেশ। এ দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এ দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৬৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী, যার মধ্যে বাংলাদেশেরই ৩৭ মিলিয়ন। বিশ্বব্যাংকের জরিপ বলছে, মহামারির আগে দেশে পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশ ন্যূনতম পড়ার দক্ষতা অর্জন করত। এ সংখ্যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ শতাংশ। আগে চার বছর বয়সে তাদের বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু হতো, এখন তা পাঁচ-কিংবা ছয় বছরে পড়তে যাচ্ছে। অর্থাৎ শুরুতেই প্রায় দুই বছর হারিয়ে যাবে প্রতিটি শিশুর শিক্ষাজীবন থেকে। কী পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ল, শিক্ষার্থীদের শিখন ফলের বাস্তবিক অবস্থাটা কী ইত্যাদি কোনো ধরনের জরিপ বা গবেষণা কি আমরা সরকারের তরফ থেকে দেখতে পেয়েছি? পাইনি। বরং কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কিছু একটা বের করে সরকারের পক্ষ থেকে তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

শিক্ষার ক্ষতির ভয়াবহতাকে প্রথম অনুধাবন করতে হবে। তারপর স্বীকার করতে হবে। এরপর সংশ্লিষ্টদের মতামত চাওয়া হবে। এসবের পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে! ব্যবস্থা নেওয়াটা কিন্তু নীতি নির্ধারকদের হাতে অর্থাৎ সরকারের হাতে। আমাদের দেশের শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয় তা হচ্ছে, শিক্ষা নিয়ে যারা গবেষণা করেন, সেগুলো সব বিচ্ছিন্ন। এর কোনো ধরনের প্রয়োগ কোথাও নেই। কে প্রয়োগ করবেন? কীভাবে করবেন? প্রয়োগ করতে হলে সরকারকে বিষয়গুলো স্বীকার করতে হবে আর যারা গবেষণা করেন তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারকে দেখানো, জানানো, বোঝানো। ফলে তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু সব জার্নালের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে। সেটি কেউ উলটেও দেখে না; যদি না কারোর পেশাগত লাভের জন্য (যেমন প্রমোশনের জন্য একটি পাবলিকেশন) কেউ একটু পড়েন কিংবা উদ্ধৃতি দেন। নীতিনির্ধারকরা এগুলো দেখেন না, শোনেন না, শুনতে চান না আর প্রয়োগ করা বা বাস্তবায়ান করা তো দূরের কথা। অনেক গবেষক আবার বেশ আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন-শিক্ষা বিষয়ে তার যথেষ্ট গবেষণা রয়েছে। কিন্তু যে গবেষণা দেশের, জাতির, শিক্ষকের, শিক্ষার্থীরা কিংবা শিক্ষা বিভাগের কোথাও কাজে লাগল না, তা শিক্ষাক্ষেত্রে কতটা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে? হয়তো গবেষক একটি ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন বা প্রমোশন পেয়েছেন কিংবা তার বিদ্যা কিছুটা ধারালো হয়েছে।

২৭ জুলাই ‘ওকলা’ নামে একটি সংগঠন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেট পরিস্থিতির প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৫তম। ইন্টারনেটের এমন পরিস্থিতি থেকেই অনলাইন শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা যাচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রমের নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও সর্বশেষ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত সমীক্ষা বলছে-করোনাকালে প্রাথমিকে ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখতে না পারা বা শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে আছে। সরকারের তরফ থেকে ঘাটতি কাটাতে এবং পড়াশোনা বিকল্প পন্থায় চালিয়ে নিতে অ্যাসাইনমেন্ট চালু করা হয়েছে। অ্যাসাইনমেন্ট একটি নতুন উদ্যোগ। যদিও এটি উচ্চশিক্ষার সঙ্গে জড়িত ছিল; কিন্তু করোনা পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করেছে এটিকে স্কুল পর্যায়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু এখানে শুরু হয়েছে ডিজিটাল বাণিজ্য ও ডিজিটাল চিটিং। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই অ্যাসইনমেন্ট নিজেরা লিখছে না; ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও ইউটিউবে প্রাপ্ত অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বিদ্যালয়ে জমা দিচ্ছে। এ নকল এড়াতে সরেজমিন মনিটরিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে মাউশি। কিন্তু এটি কি সম্ভব দু-চারটি নমুনা পরীক্ষা ছাড়া? অ্যাসাইনমেন্ট মনিটরিং কমিটি সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট সবাই করছে কি না এবং করলে কে নকল করছে, তা বের করবে। প্রমাণ পেলে উপরস্থ কর্তৃপক্ষের নজরে আনবেন। শিক্ষার্থীকে সতর্ক করবেন, যাতে এমনটি আর না ঘটে। অ্যাসাইনমেন্টগুলো শিক্ষকরা যথাযথভাবে মূল্যায়ন, সংরক্ষণ ও নম্বরগুলো সঠিকভাবে এক্সেল সিটে এন্ট্রি করছেন কি না, তাও দেখবেন। এগুলো সবই ভালো উদ্যোগ এবং এ সময়ে আর কি-ই বা করার আছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী। ৮ শতাংশ ছেলে শিশু এবং ৩ শতাংশ মেয়ে শিশু সংসারের রোজগার বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিয়োজিত হয়ে পড়েছে। বেড়ে গেছে বাল্যবিবাহ। পড়াশোনার চর্চা না থাকায় শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ পড়া ভুলে যেতে বসেছে। শিক্ষণের বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থাৎ ‘লার্নিং লস’ নিয়ে উপরের শ্রেণিতে উঠেছে অনেকেই এবং সেখানে নতুন শিখন নিয়ে এগোতে পারছে না। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। তারা বেড়ে উঠছে দুর্বল মানবসম্পদ হিসাবে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারছে না। এছাড়া বড় একটি অংশ শিক্ষাজীবন শেষ করতেই পারছে না। অনেক হতাশাগ্রস্ত হয়ে সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বেড়ে যাচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’ নামক সামাজিক ব্যধির বিষফোড়া।

মাছুম বিল্লাহ : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত, সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও বাউবি শিক্ষক

masumbillah65@gmail.com

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/457008/