২৩ আগস্ট ২০২১, সোমবার, ১২:৫৭

সর্বশেষ জরিপেও ঢাকায় বেড়েছে এডিস মশা

সচেতনতার আহ্বানে সাড়া নেই নগরবাসীর

এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন রাজধানীসহ সারাদেশে গড়ে ৩০০ জন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিনই রোগীদের কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশুও মারা গেছে। ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ছিটানোসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযান চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সচেতন হওয়ার জন্য মন্ত্রী-মেয়রদের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না নগরবাসী। এ পরিস্থিতিতে বাড়ছে এডিস মশার দৌরাত্ম্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত জরিপেও এডিস মশার ঘনত্বের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জরিপে দেখা গেছে, আগের জরিপের চেয়ে এবার প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই মশার ঘনত্ব ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বাসাবো, গোরান, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, আর কে মিশন রোড ও টিকাটুলী এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব ভয়াবহ। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মগবাজার ও নিউ ইস্কাটন এলাকায় এ মশার ঘনত্ব ব্যাপক। শুধু ডিএনসিসির মেরুল বাড্ডা ও আফতাবনগর এবং ডিএসসিসির বংশাল এলাকায় এডিস মশার অস্তিত্ব পায়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপ চালানো ৯৮টি ওয়ার্ডের দুটি ছাড়া সব ক'টিতেই এ মশার উদ্বেগজনক উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

মন্ত্রী-মেয়রদের আহ্বানে সাড়া নেই: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিসের প্রকোপ বৃদ্ধির একটি বৃত্তাকার চক্র রয়েছে। সে অনুযায়ী বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এডিস মশার প্রকোপ এবার। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনও এ ব্যাপারে সজাগ ছিল। দুই করপোরেশন বিভিন্ন রকম মশক নিধন কর্মসূচি নেওয়ার পরও গত জুন মাস থেকে আকস্মিকভাবে বাড়তে থাকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ওই মাসে ২৭২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হন। আর গত জুলাই মাসে আরও বেড়ে আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ২৮৬ জন।

উভয় সিটি করপোরেশনই জানাচ্ছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ একটি সামষ্টিক প্রক্রিয়া। কারণ, এডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ বাসাবাড়ির ভেতরেও থাকে, যেখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রবেশগম্যতা নেই। তাই এর বিস্তাররোধ অংশত নাগরিকদের সচেতনতার ওপরও নির্ভরশীল।

কিন্তু সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা চালানোর পরও এ ক্ষেত্রে নগরবাসীর মধ্যে তেমন সচেতনতা দেখা দেয়নি। ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রতি শনিবার ১০ মিনিটের জন্য বাসাবাড়ি ও আশপাশ নিজ উদ্যোগে পরিস্কার করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু নগরবাসী তা আমলে নেননি। উভয় মেয়রই বলছেন, সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামও বলছেন, কেবল মন্ত্রী-মেয়র-কর্মকর্তাদের দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এ জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রত্যেক নাগরিককেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু মন্ত্রী-মেয়ররা নগরবাসীকে বারবার আহ্বান জানালেও নগরবাসী সাড়া দিচ্ছেন না।

সরকারি অন্য সংস্থাও উদাসীন: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খানের মতে, ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করার ক্ষেত্রে দুই সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা থাকলেও সরকারি আরও ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানও এ দায় এড়াতে পারে না।

অধ্যাপক আদিল বলেন, 'গণপূর্ত অধিদপ্তর, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান কখনোই ডেঙ্গুর বিষয়ে নজর দেয়নি। ওয়াসা যেসব এলাকায় পাইপলাইন স্থাপনের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করছে, সেসব স্থানে একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমছে। সেখানে এডিস মশা ডিম পাড়ছে।' এ ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট ঠিকাদারদেরও কোনো সতর্ক করা হয়নি। এমনকি ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করার পরও ওয়াসার পক্ষ থেকে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।

সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেও ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বর্তমানে রাজধানীতেই জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অন্তত হাফ ডজন বড় বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের অধীনে একাধিক বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে। এগুলোর বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশেও এডিস মশা বংশবিস্তার করছে। এভাবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ, তিতাস গ্যাস, বিটিসিএল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়- প্রতিটি সংস্থারই গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজউক এডিস নিয়ন্ত্রণে সপ্তাহব্যাপী একটি অভিযান পরিচালনা করলেও আর কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান এডিস নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামেনি। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) তাদের সদস্যদের কিছু দিকনির্দেশনা দিলেও খোদ রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিনের মালিকানাধীন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সাইটেই এডিস মশার লার্ভা পেয়েছে সিটি করপোরেশন। এ জন্য সাইট ইঞ্জিনিয়ারকে এক মাসের কারাদণ্ডও দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, অভিযানের সময় স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা ও মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পাওয়ার কারণে মালিকদের বিভিন্ন অঙ্কের আর্থিক দণ্ড দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতেও ভবন মালিক বা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সচেতনতা জাগছে না। এমনকি তৃতীয় দফার অভিযানেও একই ভবনে এডিস মশার লার্ভা ও বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে।

এমন অবস্থায় করণীয় কী- এ প্রসঙ্গে মশকবিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, একেকটি ওয়ার্ডকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় যেসব জায়গায় এডিস মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ কাজ করতে হবে সিটি করপোরেশনকেই। তা না হলে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতে পারে।

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান সমকালকে বলেন, সবাই যে একইভাবে একই সময়ে সাড়া দেবে- এমনটা আশা করা যায় না। তবে ডিএনসিসির কর্মকর্তা ও কাউন্সিলররা সাড়া দিয়েছেন। এই সচেতনতামূলক সামাজিক আন্দোলন বাস্তবায়নের জন্য আমরা প্রচারকাজ অব্যাহত রেখেছি। নগরবাসী একসময় নিশ্চয়ই সচেতন হয়ে সাড়া দেবেন।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, জানুয়ারি থেকে মোবাইল কোর্ট, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করেছি। আগে বাসাবাড়ি পরিচ্ছন্ন করার জন্য একটা নামমাত্র ফি ধরা হয়েছিল। পরে সেটা ফ্রি করা হয়েছে। তার পরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এত বড় একটা শহরে মানুষ সচেতন না হলে কাজটা করা কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষের স্বতঃস্ম্ফূর্ত অংশগ্রহণ না থাকায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

বাড়ছে এডিসের দৌরাত্ম্য: গত ২৯ জুলাই থেকে গত ৭ আগস্টের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানে জরিপ পরিচালনা করে। গতকাল রোববার প্রকাশিত সেই জরিপে দেখা যায়, ডিএনসিসির ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড (আফতাবনগর ও মেরুল বাড্ডা) ও ডিএসসিসির ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে (বংশাল) এডিস মশার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এডিস মশার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ডিএসসিসির বাসাবো ও গোরান এলাকায়। এ দুটি এলাকায় মশার ঘনত্ব ৭৩ দশমিক ৩ বিআই (ব্রুটো ইনডেক্স)। এ ছাড়া ডিএসসিসির এলিফ্যান্ট রোড ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ৬৬.৭ বিআই। আর কে মিশন রোড ও টিকাটুলী এলাকায় ৫০.০ বিআই। বনশ্রী, মিন্টো রোড ও বেইলি রোড এলাকায় ৪০ বিআই পায় জরিপকারী দল।

ডিএনসিসির সবচেয়ে বেশি এডিস মশাপ্রবণ এলাকা হলো মগবাজার ও নিউ ইস্কাটন। এ দুটি এলাকায় মশার ঘনত্ব ৫৬.৭ বিআই। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ও নিকুঞ্জ এলাকায় ৪৮.৪ বিআই। কল্যাণপুর, দারুসসালাম এলাকায় ৪৬.৭ বিআই। মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়ায় ৪৩.৩ বিআই। মহাখালী ও নিকেতন এলাকায় ৪০.০ বিআই।

প্রসঙ্গত, এর আগে চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে পরিচালিত জরিপে সর্বোচ্চ এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া গিয়েছিল লালমাটিয়া ও ইকবাল রোড এলাকায়। সেখানে মশার ঘনত্ব ছিল ২৩.৩ বিআই। এরপর ২০.০ বিআই পাওয়া গিয়েছিল সায়েদাবাদ ও উত্তর যাত্রাবাড়ী এলাকায়। ওই জরিপে সর্বোচ্চ যে ১০টি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব পাওয়া গিয়েছিল, তার প্রতিটিতেই মশার ঘনত্ব ২০ বিআই-এর নিচে ছিল। এবার সর্বোচ্চ যে ১০টি ওয়ার্ডে মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে, তার কোনোটিতেই মশার ঘনত্ব ৪০ বিআই-এর কম নয়। ওই জরিপে মাত্রা ১৩টি এলাকা ও বাসাবাড়িতে এডিসের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। এবার ডিএনসিসির ৭৫টি ও ডিএসসিসির ৭৯টি এলাকা ও বাসাবাড়িতে এ মশার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

হাসপাতালে আরও ২৯১: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে আরও ২৯১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ২৫৯ জন রাজধানীতে। এ নিয়ে চলতি বছরে মোট আট হাজার ৪১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ছাড়া পেয়েছেন ছয় হাজার ৭৮৭ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন এক হাজার ২১৮ জন। এর মধ্যে রাজধানীর ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন এক হাজার ১৩১ জন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের।

https://samakal.com/capital/article/210874342/