২২ আগস্ট ২০২১, রবিবার, ১২:৪৫

পরিশোধে বিশেষ সুবিধা সত্ত্বেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ

মহামারি করোনাকালীন সময়ে ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও হু হু করে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমান। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা বেড়েছে। এতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট প্রদান করা ঋণের ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আদায় না করেই নানা ছাড় নিয়ে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। তারপরও খেলাপি ঋণের পরিমান এক লাখ কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই।

তথ্য বলছে, করোনা মহামারিতে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়েছে। করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কারণে চলতি বছরে ঋণ পরিশোধে বিশেষ সুবিধার মধ্যেও ব্যাংকিং খাতে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা যা ছিল মোট ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন শর্ত শিথিলের কারণে গত বছরজুড়ে ঋণ শোধ না করলেও কেউ খেলাপি হননি। এ বছর নতুন করে আগের মতো ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়নি। যেসব মেয়াদি ঋণ চলতি বছরের মার্চের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল, ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে তা জুন পর্যন্ত পরিশোধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জুন শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করে ২ লাখ ১২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ৬২ শতাংশ। মার্চে খেলাপি ছিল ৪৩ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। সে সময় বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। আর চলমান ঋণের ওপর ২০২০ সালে আরোপিত অনাদায়ী সুদ একবারে পরিশোধ না করে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিস্তিতে পরিশোধ করা যাবে- এমন সুযোগও দেওয়া হয়। এ ছাড়া তলবি ঋণ চলতি বছরের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আটটি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। তিন মাস আগে গত মার্চে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। জুন শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করে ২ লাখ ১২ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ৬২ শতাংশ। মার্চে খেলাপি ছিল ৪৩ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। সে সময় বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলো জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ৯ লাখ ৪ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। মার্চে এসব ব্যাংকের ঋণ ছিল ৮ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। মার্চে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৪৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে ৪৯ হাজার ১৯১ কোটি টাকা হয়েছে, যা এ খাতের ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। জুন শেষে বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা, যা মোট প্রদান করা ঋণের ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ হয় ৬৩ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। মার্চে বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ছিল ২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা, যা মোট প্রদান করা ঋণের ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ছিল ৫৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। জুনে বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে ৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। এ অংক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তারা বিতরণ করেছে মোট ৩২ হাজার ২০৮ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, তিনটি কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। প্রথমত, করোনার কারণে এখন ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দা। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এখন কিছু সুবিধা কমিয়ে এনেছে। কিন্তু ঋণ গ্রহীতারা মনে করছেন ঋণ শোধ না করলে আরও সুবিধা পাওয়া যাবে। যাদের ব্যবসা ভালো তারাও ঋণ শোধ করছেন না, কারণ যদি পরে ঋণ পেতে সমস্যা হয়। আর তৃতীয়ত, এখন ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ে তেমন আগ্রহ নেই। এখন আদায় না করেই নানা ছাড় নিয়ে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। ফলে ঋণ আদায় না করলেও তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আগের মত ঋণ আদায়ে চাপ দেয় না। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তিনি বলেন, এখন খেলাপি কমাতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটু তৎপর হতে হবে। ব্যাংকিং খাতের জন্য ক্ষতি হয় এমন সুবিধা বন্ধ করতে হবে। ঋণ আদায় বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন মাস অন্তর খেলাপি ঋণের যে হিসাব তৈরি করে, তাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। এর সঙ্গে অবলোপন করা আরও প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে। এ ছাড়া পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন আছে বিপুল অঙ্কের ঋণ। এর বাইরে আরও লাখ কোটি টাকার মতো আছে মেয়াদোত্তীর্ণ ও স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট বা এসএমএ ঋণ, যা খেলাপি হওয়ার আগের ধাপে আছে। এর বাইরে আরও অনেক ঋণ খেলাপির পর্যায়ে আছে, অথচ ব্যাংকগুলো সেগুলোকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করেনি। সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের অঙ্ক অনেক বেশি হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত জুন পর্যন্ত সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১২ হাজার ৫৩৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর স্থিতির পরিমাণ ৯ লাখ চার হাজার ৬৫৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন দেখা যায়, মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকে খেলাপির পরিমাণ ৪৩ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের ২০ দশমকি ৬২ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৯ হাজার ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপির পরিমাণ দুই হাজার ৪৯২ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে এর পরিমাণ তিন হাজার ৬৮৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা, যা তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। খেলাপি ঋণের অঙ্কের দিক থেকে আগে সরকারি ব্যাংকগুলো উপরে থাকলেও এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলো এগিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের অঙ্ক বেশি। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণও বেশি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। এ কারণে এ খাতে খেলাপির অঙ্ক বেড়েছে।

https://dailysangram.com/post/462413