২২ আগস্ট ২০২১, রবিবার, ১২:৪৩

মাত্র ৭ দিনে আফগানের পতন : প্রমাণ হলো মার্কিন দখলদারিত্বের পেছনে জনসমর্থন ছিল না

অনেকদিন আগে থেকে একটি ইংরেজী শব্দ শুনে আসছি। শব্দটি হলো lightning speed. অর্থাৎ বিদ্যুৎ গতি। শব্দটি শুধু শুনেই আসছি। কিন্তু কিভাবে বিদ্যুৎ গতিতে কাজ হয় সে সম্পর্কে সম্যক কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু এবার হল। এবং সেটা হল তালেবানের আফগান বিজয় দেখে। মার্কিন, ন্যাটো এবং আফগান সরকারের সম্মিলিত বাহিনী ৩ লক্ষ ৫০ হাজার। ট্যাংক, জঙ্গিবিমান, সাঁজোয়া গাড়িসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত পশ্চিমা বাহিনী এবং আফগান সরকারি বাহিনী। অন্যদিকে মান্ধাতার আমলের অ্যাসল্ট রাইফেল মর্টার এবং পোর্টেবল (কাঁধে বহনযোগ্য) রকেট লাঞ্চার সজ্জিত তালেবান বাহিনী। অথচ সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত নিয়মিত বাহিনীর কি অসহায়ভাবে লেজ গুটিয়ে পলায়ন অথবা আত্মসমর্পণ। অন্যদিকে ৪ দিনে ৩৪ টি প্রাদেশিক রাজধানী দখল এবং পঞ্চম দিনে রাজধানী কাবুলের পতন। অর্থাৎ ৫ দিনে ২ লক্ষ ৫৭ হাজার বর্গমাইলের বিশাল আফগানিস্তান দখল। হিন্দু পুরাণে আছে, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’। কিন্তু বিনাযুদ্ধে পতন হলো সমগ্র আফগানিস্তান। সেজন্যই সিএনএন, ফক্স নিউজ, বিবিসি, আলজাজিরা, নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মিডিয়া সমূহ লিখেছে, লাইটনিং স্পিডে তালেবানরা দখল করল কাবুল। পালিয়ে গেল আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি।
অথচ কাবুলের পতনের মাত্র পাঁচ/ছয় দিন আগেই গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন রয়টার্সকে জানিয়েছিল যে কাবুল অবরোধ করতে তালেবানের লাগবে ৩০ দিন। আর কাবুল দখল করতে তালেবানের লাগবে ৯০ দিন। ৯০ দিনের জায়গায় ৭ দিনেই কেল্লাফতে। এটিকে বিদ্যুৎ গতি ছাড়া আর কি বলা যায়?

॥ দুই ॥
ইংরেজি আরেকটি শব্দ আছে। সেটি হল thunderstruck. অর্থাৎ ‘বজ্রাহত’। বিদ্যুৎ গতিতে তালেবানের হাতে সমগ্র আফগানিস্তানের পতনে সমগ্র আমেরিকা বজ্রাহত। বজ্রাহত পশ্চিমা দুনিয়া। বজ্রাহত ভারত। কিভাবে এমন অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে পারল? অনেকেই এর কারণ খুঁজে ফিরছেন। কিন্তু এর একটি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দিয়েছেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, “আমাদের ধারণার চেয়েও ঘটনা অনেক দ্রুত গতিতে ঘটেছে। আফগানিস্তানের রাজনীতিবিদরা হাল ছেড়ে দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। আফগান সামরিক বাহিনী হাল ছেড়ে দিয়ে কোন যুদ্ধ করার চেষ্টাও করেনি। যে যুদ্ধে আফগান বাহিনী নিজেদের জন্য যুদ্ধ করতে আগ্রহী নয়, সে যুদ্ধে আমেরিকানরা মারা যাচ্ছে। তাই আমেরিকানরা এমন যুদ্ধ করতে পারে না, পারা উচিতও না। যে আফগান সেনা বাহিনী দুই দশক ধরে আমেরিকার প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রে সজ্জিত ছিল, কিভাবে এত দ্রুত তারা তালেবানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে?” প্রেসিডেন্ট বাইডেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে তিনি অনুতপ্ত নন। কারণ ২০ বছর কেন, আরো ২০ বছর থাকলেও ফলাফল একই হত।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে আফগান সেনাদের যুদ্ধে অনীহার আরেকটি কারণ হলো, তাদের সামনে কোন আদর্শের অনুপস্থিতি। তারা নিজেরাই জানতো না, কেন তারা এই যুদ্ধ করছে? তাদের সামনে ছিল না কোনো উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে তালেবানরা মনে করছে যে তারা ইসলামের জন্য যুদ্ধ করছে। ২০০১ সালে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে আফগানিস্তান দখল করে আমেরিকা যখন তালেবান সরকারকে উৎখাত করে তখনও তালেবানরা বলেছিল যে পরাজিত হলেও তারা ইসলামী আদর্শ ছাড়বে না। তারা একদিন না একদিন পশ্চিমা হানাদারদের বিতাড়িত করবে এবং আফগানিস্তানে আবার ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে।

॥ তিন ॥
পশ্চিমা বিশ্বের দেখাদেখি কিনা জানিনা, বাংলাদেশের বাম ও সেক্যুলার ঘরানার ইংরেজি ও বাংলা মিডিয়া এবং ঐ ঘরানার পলিটিশিয়ানরা আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো প্রত্যাহারকে hasty retreat বলে সমালোচনা করছেন। Hasty retreat, অর্থাৎ তড়িঘড়ি করে পশ্চাদপসরণ বা সরে যাওয়া বলছেন। ওরা পররাজ্য গ্রাস করে রাখলো ২০ বছর। তার পরেও হ্যাস্টি রিট্রিট? তড়িঘড়ি করে সরে যাওয়া? তাহলে কি আরো ২০ বছর থাকার দরকার ছিল? মোট ৪০ বছর? ওরা কি তাহলে চেয়েছিলেন যে চার কোটি আফগান আরো দীর্ঘ সময় মার্কিনী এবং পশ্চিমাদের পদানত থাকুক? যে দেশটি যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, সেই বাংলাদেশের ঐ সব চেনা মুখ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ বিদেশি সৈন্যের উপস্থিতি দীর্ঘায়িত করার ওকালতি কিভাবে করেন? একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিদেশি দখলদার সৈন্যের উপস্থিতি কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে খাপ খায়?
এখানেই একটি মৌলিক প্রশ্ন এসে যায়। কেন মার্কিন বাহিনী একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সামরিক শক্তির জোরে দখল করলো? কেন তারা ইরাক দখল করলো? কেন সিরিয়ায় বিদেশি শক্তি? কেন আমেরিকা ভিয়েতনামে বছরের পর বছর হামলা চালিয়েছিল? আফগানিস্তানের সাথে আমেরিকার তো কোন সীমান্ত নাই। আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (৯/১১) টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে হামলা হয়। তখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন তালেবান সরকার। আমেরিকা অভিযোগ করে যে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন আল-কায়েদা ঐ হামলা করেছে। তারা আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। ওসামা এবং আল-কায়দা নেতৃবৃন্দকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আমেরিকা তালেবান সরকারের নিকট দাবি করে। আল-কায়েদা যে ঐ হামলা করেছে তার পক্ষে আমেরিকার নিকট প্রমাণ চায় আফগান সরকার। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর ন্যাটোসহ আমেরিকা আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক হামলা চালায়। ৩ মাস ১০ দিন অবিশ্রান্ত আক্রমণের পর ১৭ ডিসেম্বর তালেবান সরকারের পতন ঘটে এবং আমেরিকা আফগানিস্তান দখল করে। মার্কিন হামলাকে প্রত্যক্ষ ও সামরিকভাবে সহযোগিতা করে তালেবান বিরোধী জোট আহমদ শাহ মাসুদ এবং আব্দুল্লা আব্দুল্লার নেতৃত্বাধীন নর্দান অ্যালায়েন্স।
॥ চার ॥
২০০১ সালের ডিসেম্বর থেকে আমেরিকা আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব বজায় রাখে। সমগ্র আফগানিস্তানে তারা চিরুনি অভিযান চালায়। কিন্তু ১০ বছর পর্যন্ত ওসামাকে খুঁজে পায়নি। অবশেষে ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামাকে মার্কিন কমান্ডোরা হত্যা করে এবং আরব সাগরের অথৈ নীল জলরাশিতে তার লাশ নিক্ষেপ করে।
ওসামাকে হত্যা করার পরেও আরো দীর্ঘ ১০ বছর, অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত মার্কিন বাহিনী কেন আফগানিস্তান দখল করে রাখলো? মাত্র ৭ দিনে তালেবানের কাছে সমগ্র আফগানিস্তানের পতন হওয়ার পর প্রমাণ হল যে মার্কিন দখলদারিত্বের পেছনে আফগান জনগণের বিন্দুমাত্র সমর্থন ছিল না।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/462411