১৭ আগস্ট ২০২১, মঙ্গলবার, ৪:১৪

বেসরকারি পর্যায়ে বিশাল মজুত গড়ে তোলায় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন

মহামারি করোনায় একদিকে আয় কমেছে অন্যদিকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের দুমুঠো খাওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। এদিকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানি পর্যায়ে ৩৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ শুল্ক কমানো হলেও বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। দাম কমাতে সরকার খোলাবাজারে চাল বিক্রি করলেও বাজারে দাম কমছে না, বরং গত কয়েক দিনে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।

গতকাল রোববার রাজধানীর মগবাজার, রামপুরা, মালিবাগ ও মধুবাগ বাজার ঘুরে দেখা গেছে মিনিকেট কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ৬২ টাকা, নাজিরশাইল ৬২ থেকে ৬৫ টাকা, আটাশ বালাম ৫০ থেকে ৫৪, পাইজাম ৫০ থেকে ৫৫, গুটি স্বর্ণা ৫০, চিনিগুড়া ৯০ থেকে ৯৫ টাকা ও বাসমতি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চাল বিক্রেতা নাজিম উদ্দিন বলেন, চাল আগের দামেই বিক্রি করছি। দাম কমেনি। শুনেছি শুল্ক কমানো হয়েছে। তবে বাজারে আমদানিকৃত চাল এখনও আসেনি। হয়তো চলতি সপ্তাহে আমদানিকৃত চাল বাজারে এলে দাম কিছুটা কমতে পারে। আমরা কম দামে কিনতে পারলে কম দামে বিক্রি করবো।

উল্লেখ্য, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১২ আগস্ট আমদানিতে শুল্ক ৩৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে কাস্টম ডিউটি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ শুল্ক ১০ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিদ্যমান রেগুলেটরি ডিউটি বা আবগারি শুল্ক ২৫ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যান্য ১.৭৫ শতাংশসহ মোট ৩৬.৭৫ শতাংশ শুল্ক কমানো হয়েছে। ছাড়কৃত শুল্ক-কর বাদ দিলে চাল আমদানিতে ২৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ বহাল থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন মূলত কয়েকজন মিল মালিক। তাদের ইচ্ছায় চালের দাম বাড়ে-কমে। এই সিন্ডিকেট যতদিনে না ভাঙবে, ততদিনে বাজার এভাবেই চলতে থাকবে। এর মধ্যে আবার মিল মালিকরাই যদি আমদানিকারক হন, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ অবস্থায় যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সব ব্যবসায়ীকে সমান শুল্ক কমানোর মাধ্যমে চাল আমদানি এবং সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর মনিটরিং হলে দাম কমার সুযোগ রয়েছে।

দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে খুচরা ব্যবসায়ীরা বরাবরই পাইকারি ও আড়তদারদের দায়ী করেন। এবারও তারা বললেন- পাইকারি ও আড়তে দাম বাড়ার কারণেই খুচরা বাজারে দাম বেড়েছে। এদিকে বাজার মনিটরিং সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হালনাগাদ তথ্য বলছে, গত শুক্রবার ভালোমানের নাজির-মিনিকেট কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৮ টাকা দরে, যা এক মাস আগে ছিল ৫৮-৬৫ টাকা। আর গত বছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছে ৫০-৬২ টাকা দরে। অর্থাৎ এক বছরে দাম বেড়েছে ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া মাঝারিমানের পাইজাম-লতা গতকাল বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৬ টাকা কেজি। এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪৬-৫০ টাকা দরে। আর গেল বছরের একই সময়ে বিক্রি হয় ৪৪-৪৫ টাকায়। এক বছরে এই মানের চাল কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৭ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। গতকাল মোটা স্বর্ণা, ইরি, চায়না চাল বিক্রি হয়েছে ৪৭-৫২ টাকা দরে। এক মাস আগে ছিল ৪৬-৫০ টাকা কেজি। গেল বছরের একই সময়ে বিক্রি হয় ৩৮-৪৮ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ এক বছরে গরিবের এই চালের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি, ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপ বলছে, করোনা মহামারীর এ সময়ের মধ্যে ২ কোটি ৪৫ লাখ লোক দরিদ্র হয়েছে। কমেছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। এমন পরিস্থিতিতেও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে, নানা ছলছুতায় মানুষের পকেট কাটছেন এবং অন্যায় মুনাফা লুটছেন। বর্তমানে তেমনি একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে চালের বাজারে। গত দেড় মাসের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ১৫ টাকা পর্যন্ত।

খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার অবশ্য গণমাধ্যমকে জানান, চালের বাজার স্থিতিশীল করতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বেসরকারিভাবে চাল আমদানির প্রক্রিয়া চলমান। শিগগিরই এর সুফল দৃশ্যমান হবে। তিনি বলেন, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার আগে দেশে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হতো শূন্য শতাংশ করারোপে এবং যে কেউ আমদানি করতে পারত। এর ফলে বাজারে আমদানিকৃত চালের সরবরাহ বেশি ছিল, ফলে দামও কমে যায়। এর ফলে কৃষক কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল। প্রান্তিক এসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে অন্য ফসলের চাষ শুরু করে। তাই কৃষক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে এবং আমদানি নিরুৎসাহিত করতে চাল আমদানিতে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ করারোপ করা হয়েছিল। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, চলমান বোরো সংগ্রহ অভিযানে ইতোমধ্যে সাড়ে আট লাখ টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। চাল সংগ্রহের সময় আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যেই শতভাগ চাল সংগ্রহ হয়ে যাবে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ০সভাপতি গোলাম রহমান জানান, মিলারদের নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে হবে। তা না হলে দিন দিন এমনই অবস্থার সৃষ্টি হবে। বড় কয়েকটি মিল মালিক পুরো চালের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই নিয়ন্ত্রণকে সরকারের ভাঙতে হবে।

এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সরকারের খাদ্যশস্যের মজুদ কমলে এক শ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী এর সুযোগ নেয়। ইতোমধ্যে খুচরা বাজারে মোটা চালের কেজি ৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই দাম গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাই সরকার চাচ্ছে দ্রুত চাল আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এ ছাড়া ওএমএসসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল প্রয়োজন। প্রাথমিকভাবে মজুদ বাড়াতে বিদেশ থেকে ১০ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই আমদানিতে ৩৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর দেশে বোরোর বাম্পার ফলন হলেও অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার শঙ্কা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সরকারের খাদ্যশস্যের মজুদ পরিস্থিতির ওপর। বোরো মৌসুমে এবার ৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান এবং ১০ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি কেজি ধানের দাম ২৭ টাকা, সিদ্ধ ও আতপ চালের দাম যথাক্রমে ৪০ ও ৩৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান ও ৭ এপ্রিল থেকে চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৩ লাখ ৩০ হাজার ১৬৮ টন ধান, ৭ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৫ টন সিদ্ধ চাল ও ৬৩ হাজার ৬৫৫ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। এখনো ৩ লাখ ১৯ হাজার ৮৩২ টন ধান ও ১ লাখ ৪১ হাজার ১৮৭ টন চাল সংগ্রহ হয়নি। অথচ চলতি আগস্টেই বোরো সংগ্রহ অভিযান শেষ হচ্ছে। সংগ্রহ অভিযান সফল না হওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়ে খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সরকার ধান-চালের যে সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে, তার চেয়ে বাজারে দাম বেশি। তাই কৃষক ও মিলাররা সরকারের গুদামে ধান-চাল সরবরাহে আগ্রহী নন।

অভিযোগ রয়েছে, চালের বাজারে এমন কিছু মাফিয়া সৃষ্টি হয়েছে, যারা চালের দাম তো কমাচ্ছেই না, উপরন্তু বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কোটি টাকা ঋণ নিয়ে চাল মজুদ করে রাখছে। তারা সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা অতিমারির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে এভাবে চালের দামের অস্থিতিশীলতা মেনে নেওয়ার মতো নয়। এজন্যই ওএমএসের কার্যক্রমে ঢিল দেওয়া যাবে না। বাজারের বর্তমান অবস্থায় চালের দাম কমাতে হলে পুরোদমে ওএমএস কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সরকারের কাছে চালের মজুদ থাকা যেমন দরকার, এর চেয়ে বেশি জরুরি তা অসহায়দের কাছে পৌঁছানো। করোনাকালে নিম্নবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের পাশে দাঁড়াতে টিসিবির ট্রাকসেল ও ওএমএস কার্যক্রম জোরদার করার বিকল্প নেই। টিসিবির পণ্য ও খোলাবাজারে ওএমএসের চাল প্রধানত নিম্নবিত্তের জন্য হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে মধ্যবিত্তও দাঁড়াচ্ছে। গত বছর থেকে করোনা অতিমারির প্রভাবে মধ্যবিত্তের অনেকেই যে সংকটে পড়েছেন, তা স্পষ্ট। এসব মানুষের দু’বেলা দুমুঠো খাওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

বোরোর ভরা মৌসুমে বাংলাদেশের মানুষকে অনেক চড়া দামে চাল কিনে খেতে হচ্ছে। সরকারের হিসেবেই গতবারের চেয়ে এবার চালের দাম ১৫ শতাংশের মতো বেড়েছে। অথচ এবার বাম্পার ফলন হয়েছে বলে দাবি করছে সরকার। তাহলে চালের বাজার এতো চড়া কেন তার যথার্থ উত্তর মিলছে না। দেশে খাদ্যের মজুদ গড়তে সরকার নিয়মিত ধান-চাল সংগ্রহ করলেও বাজারের উপর কার্যকর নজরদারি নেই। ফলে কেন দাম বাড়ছে সে বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যও মিলছে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটোমেজর হাস্কিং রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী জানান, মিল গেইটে চালের দাম বৃদ্ধির খবর একেবারেই ‘ভিত্তিহীন’। ঢাকার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা কাদের কাছ থেকে চাল কেনেন তা নিয়ে অনুসন্ধান চালালে ‘কারসাজির’ উৎস মিলবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। খুচরায় চালের চড়া দরের জন্য মিলাররা ‘মোটেও দায়ী নয়’ দাবি করে তিনি জানান, কেউ যদি মনে করে মিলাররা উচ্চ দামে চাল বিক্রি করছে, তিনি তাহলে চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারেন। দামে কীভাবে এত পার্থক্য হয় সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুঁজে বের করুক।

মজুদ তলানীতে ঠেকে যাওয়ার পর এখন চাল আমদানি বাড়াচ্ছে সরকার; চাল আসছে ভারত থেকেও তবু কেন দাম বাড়ছে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানান, ধানের উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও এবার ধানের দাম বেশ চড়া। সে কারণে চালের দামও বেশি- এমন দাবি মিলাররা করছেন। এসব কারণে এখনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় তিন লাখ টন চাল সংগ্রহ বাকি রয়ে গেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। আমরা বিদেশ থেকে চাল আমদানি অব্যাহত রেখেছি। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে যেন চাল আমদানি করা যায় সেই চেষ্টা চালাচ্ছি।

https://dailysangram.com/post/461984