আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকায় কমিটি মন্তব্য করেছে, এর ফলে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারগুলো বিচার পাচ্ছে না
৩০ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:০০

বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের উচ্চ হারে জাতিসংঘের উদ্বেগ

জাতিসংঘ বাংলাদেশে রাষ্ট্রের প্রতিভূ বা প্রতিনিধিত্বকারীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব না দেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে পুলিশ, র্যা ব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে উচ্চ হারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও শুনানির পর জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি গত মঙ্গলবার যে পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে, তাতে এসব উদ্বেগ জানানো হয়। ওই পর্যবেক্ষণে দেশে নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ-জাতি ও গোষ্ঠীগত বৈষম্য, রাজনৈতিক অধিকার, নারী নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই, বিশেষ ক্ষমতা আইন, বাল্যবিবাহের মতো বিষয়গুলোতে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে।
৬ ও ৭ মার্চ জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল কভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপি) সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ সরকার নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসমূহ বাস্তবায়নে কী কী আইনগত এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়েছে, তার বিবরণ তুলে ধরেন। এই উন্মুক্ত অধিবেশনের আগে সরকার লিখিতভাবে তার প্রতিবেদন দেয় এবং বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী ও মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখিত বক্তব্য পেশ করা হয়।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব অভিযোগ তদন্তের পূর্ণ অধিকার দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় সম্পদ জোগানোর সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে তার সদস্যদের নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং কার্যপদ্ধতির ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত নীতিমালা (প্যারিস নীতিমালা) অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে।
আইপিসিসির স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ওই কভনেন্ট বা সনদে বর্ণিত সব নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার দেশের নিজস্ব আইনে এখনো পুরোপুরি সংযোজিত না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে কমিটি বলেছে, এগুলো পুরোপুরি সংযুক্ত করার লক্ষ্যে দেশের সব আইনের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করা উচিত। তা ছাড়া যেসব আইন ওই সনদের পরিপন্থী, সেগুলো বাতিল করার কথাও তারা বলেছে।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ‘ক্ষতিকর বা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ’ এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯-এর ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপের’ সংজ্ঞায় আপত্তি জানিয়ে এতে বলা হয়েছে, এর ব্যাখ্যা এতই ব্যাপক যে তা স্বেচ্ছাচারমূলকভাবে ব্যবহার বা অপপ্রয়োগ করা সম্ভব। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগের খবরেও কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি বাধা।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি এসব অভিযোগের ক্ষেত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকায় কমিটি মন্তব্য করে যে এর ফলে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারগুলো বিচার পাচ্ছে না। দেশের আইনে গুমের স্বীকৃতি না থাকা এবং তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত না হওয়ায় তাঁরা আরও বেশি উদ্বিগ্ন বলে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে অবিলম্বে আইন পর্যালোচনা করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের শক্তিপ্রয়োগের মৌলিক নীতিমালা ঠিক করাসহ জবাবদিহির ব্যবস্থা করার আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে কমিটি বাংলাদেশ সরকারকে তার আগামী প্রতিবেদনে কতগুলো অভিযোগের তদন্ত করা হয়েছে এবং কতজনের সাজা হয়েছে, তার বিস্তারিত জানাতে বলেছে।
আটক অবস্থায় নির্যাতনের কোনো অভিযোগ তদন্তাধীন নেই বলে সরকারি প্রতিবেদনে উল্লেখ করার পটভূমিতে কমিটি বলেছে, স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগের ব্যাপকতার কারণে তারা উদ্বিগ্ন। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইন থাকা সত্ত্বেও এটি ঘটতে থাকায় কমিটি এ বিষয়ে অভিযোগ জানানো ও তা তদন্তের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করে।
সাংবাদিক, ব্লগার, মানবাধিকারকর্মীদের এবং নাগরিক সংগঠন বা এনজিওগুলোর অধিকার খর্ব করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘের কমিটি বলছে, এগুলো মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। এ বিষয়ে তিনটি সুপারিশে বেআইনি হয়রানি, হুমকি ও হত্যার হুমকি থেকে সুরক্ষা দেওয়া, এসব অধিকার খর্বকারী আইন সংশোধন এবং অভিযোগ স্বাধীনভাবে তদন্তের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এগুলোর মধ্যে এনজিওগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিধি, বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলেরও সুপারিশ রয়েছে। কমিটি বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ১৮ বছরের নিচে বিশেষ বিবেচনার বিধান বিলোপেরও আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ এই প্রতিবেদন পেশ করায় কমিটি তাকে স্বাগত জানালেও ১৪ বছর বিলম্বের জন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করে। কমিটি একই সঙ্গে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিকার ও সুরক্ষা আইন, জাতীয় নারী নীতি, মানব পাচার প্রতিরোধ আইন, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন এবং হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু প্রতিকার আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানায়।
আইসিসিপি হচ্ছে ব্যক্তির জীবনধারণ, ধর্মপালন, মতপ্রকাশ, সংগঠন এবং নির্বাচনী অধিকারগুলোর মতো মৌলিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ, যা ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত হয় এবং ১৯৭৬ সাল থেকে তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ এই সনদে অনুস্বাক্ষর করে ২০০০ সালে। এই সনদের আওতায় স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে সাধারণত প্রতি চার বছরে একবার নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো সুরক্ষার বিষয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে হয়। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আইসিসিপির একটি কমিটি, যা জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি নামে পরিচিত। ১৮ জন বিশেষজ্ঞের এই কমিটি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সুপারিশ করতে পারে।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1127146/