১৫ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৫:২৭

সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে পঙ্গু হাসপাতাল

তিন টেকনোলজিস্টের একটি গ্রুপ চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক বদলি * স্থগিতাদেশ সুবিধায় থেকে যায় অপরাধীরা, এ কারণে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না -পরিচালক (প্রশাসন)

তিন মেডিকেল টেকনোলজিস্টের নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতাল। তারা রোগীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে। সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে হাসপাতালে নানা ধরনের অপকর্ম চালায়। এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, এমআরআই নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত এই সিন্ডিকেট।

কর্তৃপক্ষ একাধিকবার সতর্ক করলেও তাতে কর্ণপাত করেনি। উল্টো তাদেরই হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শ করে নিজেদের অপকর্ম চালিয়ে যেত। তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া এই তিনজনকে শাস্তিমূলক বদলি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

কিন্তু তারা প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল থেকে বদলির ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছে। ফলে হাসপাতালে এখন তাদের প্রভাবই বহাল। আগের চেয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের তিনজন টেকনোলজিস্টের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ পায় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। তারপর হাসপাতালের যুগ্ম পরিচালক ডা. তড়িৎ কুমার সাহাকে সভাপতি করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পায়।

এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত ৬ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাদের শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। সেখানে বলা হয়- জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওগ্রাফি) মো. হুমায়ুন কবির, মো. হেলালুল মোজাম্মেল ও মো. আবদুল বারেককে যথাক্রমে বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় ন্যস্ত করা হল।

আগামী ৫ দিনের মধ্যে বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান না করলে ৬ দিন থেকে তিনি সরাসরি অব্যাহতি পেয়েছেন বলে গণ্য হবে। কিন্তু যোগদানের তারিখ শেষ হওয়ার আগেই সিন্ডিকেটের এ তিন সদস্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল থেকে বদলির ওপর স্থগিতাদেশ এনে জমা দেন।

এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গনি মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া এসব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ তিনজন দীর্ঘদিন নানা অপকর্ম করে আসছে। তদন্তে সেগুলোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তাদের বদলি করা হল। কিন্তু প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল থেকে এ অপরাধীরা স্থগিতাদেশ পেয়েছে। এখন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটির সদস্য এবং হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাকসুদা বেগম ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. শহিদুল ইসলাম তাদের মতামত প্রদান করেন। যেখানে এ তিন টেকনোলজিস্টের ভয়ংকর চরিত্র উন্মোচিত হয়।

তারা বলেন, গত ১০ বছরে হুমায়ুন কবির সম্পর্কে রোগীদের কাছ থেকে অনেক অভিযোগ এসেছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে এক্স-রে করার বিনিময়ে সরকারি ফি’র বাইরে রোগীপ্রতি অতিরিক্ত ১০০-২০০ টাকা আদায় এবং রোগীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার ইত্যাদি।

একপর্যায়ে হুমায়ুন কবির সিটিস্ক্যান করার দাবি জানালে তাকে অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে সে বিনা রশিদে রোগীদের সিটিস্ক্যান শুরু করে। এ অপরাধে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে হুমায়ুনের দুর্নীতি প্রমাণের জন্য হাসপাতাল পরিচালকের মৌখিক নির্দেশে ইমার্জেন্সি এক্স-রে রুমে দুটি অনলাইন সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়।

কিন্তু এতে হুমায়ুন ক্ষুব্ধ হন ও চিকিৎসকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। রাতে সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে রাখেন। এমনকি বিভাগীয় প্রধানের নির্দেশ অমান্য করে বহিরাগতদের দিয়ে হাসপাতালে ডিউটি করাতে থাকেন। যারা রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে তাকে সাহায্য করে। তিনি বিভাগীয় প্রধানের কোনো নির্দেশ মানতেন না, ঠিকমতো ডিউটি রোস্টার না মেনে নিজের মর্জিমাফিক কাজ করতেন। কোনো অনিয়মে বাধা দিলেই কটূক্তি করতেন। এমনকি নানা হুমকি দিতেন। ডিউটিতে থাকাবস্থায় হাসপাতালে থেকেই নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এমনকি মদ্যপ অবস্থায় হাসপাতালে চলাফেরা করতেন এবং সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন।

হেলাল মোজাদ্দেদ সম্পর্কে তদন্ত কমিটি বলেন, হেলাল জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে কর্মরত ছিলেন। সেখানে এক্স-রে, সিটিস্ক্যান ও এমআরআই বন্ধ থাকায় এবং হুমায়ুন কবিরের আত্মীয় হওয়ায় নিটোরে নবসৃষ্ট পদে বদলি হয়ে আসেন। সিটিস্ক্যান, এমআরআই রোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন না। সিটিস্ক্যান ও এমআরআই রোগীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতেন। এসব অনৈতিক কাজে হাসপাতালের বাইরের লোক ব্যবহার করতেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি ছাড়াই তাদের কথোপকথন রেকর্ড করে ব্ল্যাকমেইল করতেন। বিভাগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তর ছবি তুলে হাসপাতালে বাইরের লোকজনের কাছে পাচার করতেন। এমনকি কর্মকর্তাদের অজ্ঞাতে তাদের কম্পিউটার ব্যবহার করতেন।

আবদুল বারেক সম্পর্কে তদন্ত কমিটির বক্তব্য- বারেক এক্স-রে ও সিটিস্ক্যান করে রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিতেন- এটা তিনি নিজেই বহুবার স্বীকার করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, কারও নির্দেশনাই মানতেন না। এমনকি কোভিড-১৯ নির্ধারিত হাসপাতালে তাকে প্রেষণে পাঠানো হলেও কোয়ারেন্টিন সময়ে অধিপত্য বজায় রাখতে এই বিভাগে আসতেন।

তদন্ত কমিটির কাছে দেয়া তথ্যে দেখা যায়, মো. হুমায়ুন কবির পঙ্গু হাসপাতালে যোগদান করেছেন ২০০৮ সালে, আবদুল বারেক ২০০৩ সালে এবং মো. হেলালুল মোজাদ্দেদ যোগদান করেছেন চলতি বছরের শুরুর দিকে। এই তিনজনই দাবি করেছেন তারা এমআরআই এবং সিটিস্ক্যান করেন না, তাই রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার প্রশ্নই আসে না। এমনকি তারা এক্স-রে করেও রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেন না বলে জানিয়েছেন। তবে তারা হাসপাতালে বাইরের লোক দিয়ে কাজ করোনার কথা স্বীকার করেছেন।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম যুগান্তরকে বলেন, তদন্তে তিনজন টেকনোলজিস্টের অপরাধ প্রমাণ হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অধিদফতর থেকে তাদের বদলি করা হয়েছে। কিন্তু তারা বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান না করে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল থেকে স্থগিতাদেশ এনেছে। যেটা আমি আজই হাতে পেয়েছি। তিনি বলেন, এ ধরনের স্থগিতাদেশ বলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এমনকি এতে প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। হাসান ইমাম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালক, অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত অর্ধশত চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছে। তারা সবাই বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান করেছেন; কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কোনো নির্দেশ দিলেই তারা আদেশ অমান্য করে। এতে স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ বিনষ্ট হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/355001