২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার, ৫:৪০

মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাধীন কমিশন!

সব শীর্ষ পদে সরকারেরই সাবেক কর্মকর্তারা

জনস্বার্থ রক্ষা ও জনসেবায় অনেক সময় সরকারি প্রতিষ্ঠান যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে না বলে আলাদা আইন প্রণয়ন করে গঠন করা হয় কমিশন। যেমন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, নদী রক্ষা কমিশন, আইন কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইত্যাদি। এসব কমিশন সংবিধান ও আইনের আলোকে স্বাধীনভাবে সরকারকে জনস্বার্থ বিষয়ক বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এসব কমিশনকে তাদের অধীনে থাকা অন্যান্য দপ্তরের মতোই মনে করে।

আবার এসব কমিশনের নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে শিক্ষক, সমাজচিন্তক, বিচারপতি, সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নির্মোহ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার কথা, যাতে তাঁরা সরকারের যেকোনো ভুল উদ্যোগ সহজেই ধরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে কমিশনগুলোর শীর্ষ পদগুলোতে প্রায় শতভাগ সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে। এতে কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জাতীয় তথ্য বাতায়নে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের পৃথক ওয়েবসাইট আছে। সেখানে মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তর ও সংস্থার তালিকার মধ্যে বিভিন্ন কমিশনের নামও রাখা হয়েছে। এটা কমিশনের স্বাধীনসত্তার অমর্যাদা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, কমিশনকে মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রাখলে প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনসত্তার মর্যাদাহানি হয়। এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। অধীন দপ্তরের তালিকায় দেখলে সাধারণ মানুষ মনে করতে পারে, অন্যান্য দপ্তরের মতো কমিশনও মন্ত্রণালয়ের একটি দপ্তর।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়গুলো সব ক্ষেত্রেই নিজেদের খবরদারি বজায় রাখতে চায়। মন্ত্রণালয় ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে কমিশন গঠনেরই প্রয়োজন হতো না। এখন কমিশন গঠনের পরও যদি সেগুলোকে নিজেদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় রাখে তাহলে কমিশন গঠন না করে আরেকটি দপ্তর করলেই হতো।’

জাতীয় তথ্য বাতায়নে সরকারের অধীন থাকা সব প্রতিষ্ঠানের ওয়েব লিংক দেওয়া আছে। এর মধ্যে ৫৮টি মন্ত্রণালয়, ৩৫৩টি অধিদপ্তর, আট বিভাগ, ৬৪ জেলা, ৪৯২ উপজেলা এবং চার হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়নের ওয়েবসাইট রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের তালিকায় রাখা হয়েছে জাতীয় সংসদ সচিবালয়কেও। রাষ্ট্রের মূল তিনটি স্তম্ভের অন্যতম জাতীয় সংসদের ওয়েবসাইটকে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তালিকায় কেন তোলা হয়েছে তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব (ই-গভর্ন্যান্স) ড. উর্মি বিনতে সালাম। তবে মন্ত্রণালয়ের দপ্তরের তালিকায় কমিশনের ওয়েবসাইট থাকার বিষয়ে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজের সম্পর্ক, তাই মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে কমিশনের ওয়েব লিংক রাখাটা অযৌক্তিক নয়।’

সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব জাফর আহমেদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অসাবধানতাবশত মন্ত্রণালয়ের তালিকায় সংসদ সচিবালয়ের নাম তোলা হয়েছে কি না জানি না। তবে এটা হওয়া উচিত নয়।’ তিনি বলেন, ‘আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিনটি মৌলিক অঙ্গ। এগুলো পরস্পর স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়। এখানে কেউ কারো অধীন নয়।’

মন্ত্রণালয়ের অধীন সাধারণত বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, করপোরেশন, কর্তৃপক্ষ, কাউন্সিল, সংস্থা, একাডেমি, ফাউন্ডেশন, ট্রাস্ট, বোর্ড, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ইনস্টিটিউটগুলো থাকে। কিন্তু জাতীয় তথ্য বাতায়ন ঘেঁটে দেখা গেছে, অন্তত ১১টি মন্ত্রণালয় তাদের অধীন দপ্তরের তালিকায় বিভিন্ন কমিশনের নামও রেখেছে। এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। আইন মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন, আইন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস রেগুলেটরি কমিশন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

দুটি মন্ত্রণালয়ের তালিকায় দুই সাংবিধানিক কমিশনকেও দেখানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওয়েবসাইটে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফিসকেও দেখানো হয়েছে।

এসব প্রসঙ্গে নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা চরম অযৌক্তিক। সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান এসংক্রান্ত কাজগুলো ঠিকমতো করলে কমিশন গঠনের প্রয়োজন হতো না।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডাব্লিউটিএ, পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব প্রতিষ্ঠানের যৌথ দায়িত্ব ছিল নদী রক্ষা করা। তারা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে নদী রক্ষার জন্য আলাদা কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনকেও যদি মন্ত্রণালয়ের অধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো মনে করা হয় তাহলে তো কমিশন গঠনের দরকার ছিল না।’

আবার কমিশনে কাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে কমিশনগুলোর শীর্ষপদগুলোতে প্রায় শতভাগ সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে। মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কমিশনগুলোতে সাবেক সচিবরা দায়িত্ব পালন করছেন।

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালে অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান প্রায়ই সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যে মানুষটি সারা জীবন সরকারের আনুগত্যের চাকরি করেছেন তিনি শেষ জীবনে সরকারের কাজের সমালোচনা করবেন কিভাবে? কিভাবে স্বাধীনভাবে সরকারকে কাজের পরামর্শ দেবেন?’ ড. মিজানের মতে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে কমিশনের লিংক পৃথকভাবে থাকতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই অন্য দপ্তর বা সংস্থার সঙ্গে কমিশনের অবস্থান হতে পারে না।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মানবাধিকার কমিশনের কাছে সাধারণ মানুষ অধিকার রক্ষার দাবি নিয়ে যায় না। কারণ মানুষ জানে কমিশন মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে না, কমিশনের লোকজন চাকরি করেন, বেতন নেন। আর সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে গিয়ে ড্রয়িংরুম বৈঠক করেন। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁরা যান না।’

তবে বিদ্যমান কমিশনগুলোর মধ্যে নদী রক্ষা কমিশন, তথ্য কমিশনসহ কিছু কিছু কমিশন নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে বেশির ভাগ কমিশন শক্ত আইনি অবস্থান থাকার পরও নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে পারছে না বলে অনেকে মনে করেন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/09/26/959284