১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ১:১৪

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু : প্রথম মামলার ল্যান্ডমার্ক রায় : ন্যায়বিচার সমুন্নত

আসিফ আরসালান : আইনের শাসন যেমন সভ্য সমাজের ভিত্তি, তেমনি আইনের শাসন গণতন্ত্রেরও চাবিকাঠি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। এই কথাটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগেও যেমন বলা হয়েছে, পরেও তেমনি বলা হয়েছে। বলা হয়েছে অসংখ্যবার। বলেছেন সব দেশের সব রাজনীতিবিদ। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশে নির্ভেজাল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খবরে বছরের পর বছর ধরে পত্র পত্রিকাসমূহ ভরপুর ছিল। আরও সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল, বছরের পর বছর ধরে এসব বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খবর নিয়মিত প্রকাশিত হলেও সেগুলোর একটিরও আইনানুগ বিচার হয়নি। আইনানুগ বলতে আমরা বিচার বিভাগের অধীনের বিচার বলছি। বিভাগীয় বিচার, অর্থাৎ পুলিশ বিভাগের অফিসার দিয়ে পুলিশের বিচার হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নাই।

বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে দুই ধরনের হত্যাকাণ্ডের খবর পত্র পত্রিকায় দেখা যায়। একটি হল বন্দুক যুদ্ধ, এনকাউন্টার ইত্যাদি। আরেকটি হল পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যু। এ ধরনের বিচার বিভাগীয় হত্যাকাণ্ডের খবর প্রতিনিয়ত পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পটভূমিকায় প্রণীত হয় ২০১৩ সালে ‘নির্যাতন এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু (প্রতিরোধ) আইন। এই আইনের অধীনে বিগত ৭ বছরে একটি মাত্র মামলা দায়েরের কথা জানা যায়। পত্র পত্রিকার খবর মোতাবেক ৭ বছর আগে আইন প্রণীত হলেও এই ৭ বছরে অন্য কেউ ভয়ে মামলা করার সাহস পায়নি। ভয় তাদেরকে নিয়ে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।

স্বস্তির বিষয় ৬ বছর আগে দায়ের করা একটি মামলার রায় ৬ বছর পরে হলেও প্রকাশিত হয়েছে এবং এই মামলার রায়কে সংশ্লিষ্ট সকলে বিপুলভাবে অভিনন্দিত করছেন। কেউ বলছেন ল্যান্ডমার্ক রায়, কেউ বলছেন মাইলফলক রায়। ৬ বছর আগে ২০১৪ সালে পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে পুলিশী নির্যাতনে ইশতিয়াক হোসেন জনি নামক এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৬ বছর পর গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি আদালত অভিযুক্ত তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং পুলিশের দুই সোর্সকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এছাড়া তিনজন পুলিশ সদস্যকে ১ লক্ষ টাকা করে এবং দুই সোর্সকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন। অনাদায়ে কয়েক মাসের কারাদণ্ড ভোগের রায় হয়েছে। রায়ে আরও বলা হয়েছে যে বাদী পক্ষকে অভিযুক্ত তিন পুলিশ প্রত্যেকে দুই লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ হিসাবে প্রদান করবে। একটি জীবন যেখানে ঝরে গেছে সেখানে যে কোনো পরিমাণ অর্থই হোক, সেটা কোনো বিনিময় হতে পারে না। তৎসত্ত্বেও ভিকটিমের পরিবার এতটুকু সান্তনা পাবে যে বিলম্বে হলেও তারা বিচার পেয়েছে। যারা ভয়ে এতদিন মামলা করার সাহস পায়নি, এই রায়ের পর তাদের ভয় অনেকটা কেটে যাবে এবং অন্যান্য বিচার প্রার্থী ন্যায়বিচারের আশায় মামলা করতে এগিয়ে আসবেন।

বিচারকের রায়ে জনির ওপর পরিচালিত অত্যাচারকে ভয়াবহ এবং নৃশংস বলা হয়েছে। বিষয়টি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় যে ২০১৩ সালে পুলিশী হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে আইন প্রণীত হওয়ার পর এই ধরণের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর অর্থ হল, তারা আইনকে তেমন আমলেই নেয়নি। আরেকটি কারণ হতে পারে, আইন প্রণয়নের পর কয়েক বছরেও যখন কারও শাস্তি হয়নি তখন তাদের কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, একটি তথ্যে।

পত্রিকান্তরে ১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে যে জাতিসংঘের নির্যাতন কমিটিতে বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা রিপোর্ট করেছে যে ২০১৩ সালে এই আইন প্রণীত হওয়ার পর বাংলাদেশে ৩৪৮ জন বন্দীর পুলিশ কাস্টডিতে মৃত্যু ঘটেছে।

বিচার বহির্ভূত হত্যা, সেটা পুলিশ কাস্টডিতে হোক, অথবা অন্য কোনোভাবে হোক, যখনই এরকম ঘটনা ঘটেছে তখনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে এসেছে গৎবাধা জবাব। অথবা ঐ ধরনের অভিযোগকে সরাসরি করা হয়েছে অস্বীকার। যখনই এই ধরনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, অথবা অভিযোগের আঙ্গুল উত্থিত হয়, তখন জনগণ এতটুকু আশা করেন যে অন্তত একটি তদন্ত অনুষ্ঠিত হবে। আর সেই তদন্ত স্বাধীনভাবে অনুষ্ঠিত হবে। পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত যদি পুলিশ করে তাহলে সেই তদন্ত কতদূর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

জনির ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য জনির পরিবার, বিশেষ করে তার ভাইকে কত প্রতিকূলতা পার হতে হয়েছে। মামলায় বাদীর বিবরণী থেকে দেখা যায় যে , ৬ বছর ধরে জনির ভাই এবং তাদের পরিবারকে কত হুমকি ধামকির মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। হুমকি ধামকির অভিযোগ উত্থিত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে, যাদের বিরুদ্ধে জনিকে নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।

দেশে পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা দুই লক্ষাধিক বলে জানা যায়। এই বিরাট সংখ্যার সিংহভাগই কোনো অপরাধে জড়িত নন। বরং এই সিংহ ভাগ সদস্য সৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ। সমগ্র পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মুষ্টিমেয় হাতে গোনা কয়েকজন অসৎ এবং অপরাধ মনস্ক সদস্যদের জন্য দুই লক্ষাধিক সদস্যের বিশাল বাহিনীকে বদনামের ভাগী হতে হয়। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। সে কারণেই সৎ অফিসার এবং নন অফিসারদের কর্তব্য হওয়া উচিত, নিজেদের অভ্যন্তরেই এসব অসৎ, দুর্নীতিপরায়ণ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা।

রিমান্ডে নিয়ে বা পুলিশ কাস্টডিতে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে বেশ কয়েক বছর আগে মাননীয় হাইকোর্টের তরফ থেকে ১৫ বা ১৬ দফা নীতিমালা দেয়া হয়েছে। কখন , কোথায়, কিভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে তার সুস্পষ্ট গাইডলাইন দেয়া আছে। কিন্তু কোথাও এরকম বিধান নাই যে জিজ্ঞাসাবাদের নামে, তথ্য আদায়ের নামে আসামীর ওপর শারিরীক নির্যাতন করতে হবে।

॥ তিন ॥
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে আইনটি প্রণয়ণের পর এটি প্রথম একটি বিচার বিভাগীয় রায়। এবং সকলেই এই রায়কে ঐহিতাসিক এবং দৃষ্টান্তমূলক রায় বলে আখ্যায়িত করেছেন।

এটি সাড়ে ৬ বছর আগের ঘটনা। তাই ঘটনাটি হয়তো অনেকে ভুলে গিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ডেইলি স্টারের ৮ম পৃষ্ঠায় এই মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নিহত ইশতিয়াক হোসেন জনি এবং তার ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি একটি বিয়ের হলুদ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সেখানে সুমন এবং রাসেল নামক দুই ব্যক্তি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অনুষ্ঠানের মঞ্চে ওঠে এবং মেয়েদেরকে যৌন হয়রানি শুরু করে। জনি এবং রকির কাছে মদ্যপদের এই আচরণ সহনশীলতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। তারা মাতালদেরকে বাধা দেয়। ফলে রকি ও জনির সাথে মদ্যপদের মারামারি হয় এবং মাতালরা মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হয়।

কিছুক্ষণ পর সুমন এবং রাসেল ২৫ জন পুলিশ নিয়ে হাজির হয় এবং দুই ভাই রকি এবং জনিকে গ্রেফতার করে পল্লবী থানায় নিয়ে যায়। কে জানতো যে সেটিই হবে জনির জীবনের শেষ রাত। পরদিন একটি হাসপাতালে জনির রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ নেয়া হয়। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জনিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। জনির ভাই রকিও পুলিশের হেফাজতে দারুণভাবে নির্যাতিত হন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে রকি বেঁচে যান এবং ৭ দিন পর থানা থেকে ছাড়া পান। ছাড়া পেয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি ভাইয়ের হত্যার বিচার চাইবেন। রকি নিজেও পুলিশী জুলুমের শিকার হয়েছিলেন। তাঁর ওপর সংঘঠিত নির্যাতনের বিচার তিনি চাইতে পারতেন। কিন্তু তিনি দৃঢ় সংকল্প করেন যে , যে কোনো মূল্যে তার ভাইয়ের হত্যার ন্যায়বিচার তাকে পেতেই হবে।

পরবর্তী ৬ বছরের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ এবং করুণ। সেই ইতিহাসে বিধৃত রয়েছে, কিভাবে রকি এই মামলায় পদে পদে হোঁচট খেয়েছেন, কিভাবে এই মামলা সমাধিস্থ হতে হতে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। এমন একটা সময় এসেছিল যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ এটিকে পুলিশী জুলুমের ফল না বলে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেটি ছিল ২০১৪ সালের ৯ মার্চ। জনি হত্যার ঠিক ২৯ দিন পর। ঢাকা মেডিকেল কলেজের এই রিপোর্টের ভিত্তি ছিল পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট। রকি ঢাকার সেশন জজ কোর্ট আদালতে ঢামেকের রিপোর্ট চ্যালেঞ্জ করেন। সেশন জজ কোর্টের নির্দেশক্রমে চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করেন। তদন্তে বলা হয় যে পুলিশের নির্যাতনে জনির মৃত্যু হয়েছে।

পরবর্তী ইতিহাসে আমরা আর যাবো না। প্রথমে আমরা অভিনন্দন জানাই রকি এবং তার পরিবারকে, তাদের অসাধারণ ধৈর্য এবং সাহসিকতার জন্য। অভিনন্দন জানাই ঢাকার সেই আদালতকে, যে আদালত এই যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। এই আদালত পথ দেখিয়ে দিয়েছে অন্যান্য মজলুম মানুষকে যারা নিজেদেরকে ইনসাফ বঞ্চিত মনে করেন। বাংলাদেশে আজও ন্যায়বিচার পাওয়া যায় যদি ধৈর্যের সাথে এবং নির্ভীকভাবে আইনের পথ অনুসরণ করা যায়।

asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/427227