২৭ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:০৮

দাম্ভিক শাসকদের পছন্দ করে না মানুষ

২৯ বিদেশী নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল ভারতের মহারাষ্ট্র সরকার। অভিযোগ, করোনা মহামারীর মধ্যে দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে তাবলীগ জামাতের সমাবেশে যোগ দিয়ে ওরা ভাইরাস ছড়িয়েছে। ভারতের গণমাধ্যম এনডিটিভি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে মুম্বাইয়ের উচ্চ আদালত।

আদালতের আওরঙ্গবাদ বেঞ্চ তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, রাজনৈতিক সরকার এসব বিদেশিদের বলির পাঁঠা বানিয়েছে। মুম্বাই উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, ‘দিল্লির মারকাজে যোগ দেয়া বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বড় ধরনের প্রচারণা চালানো হয় আর এমন একটি পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করা হয় যেন ভারতের কোভিড-১৯ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী এসব বিদেশিরা। এসব বিদেশিদের বিরুদ্ধে ভার্চুয়াল নিপীড়ন চালানো হয়েছে।’ আদালতের রায়ে আরও বলা হয়, ‘কোন মহামারী কিংবা বিপর্যয় হলে’ একটি রাজনৈতিক সরকার বলির পাঁঠা খোঁজার চেষ্টা করে আর পারিপাশির্^ক পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে যে, এই বিদেশীদের সম্ভব বলির পাঁঠা হিসেবে বেছে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।’

মুম্বাই উচ্চ আদালতের রায়ে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে যা মানুষের রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সমাজ-সভ্যতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রায়ে বলা হয়েছে, কোন মহামারি কিংবা বিপর্যয় হলে রাজনৈতিক সরকার বলির পাঁঠা খোঁজার চেষ্টা করে। অর্থাৎ সত্য অনুসন্ধান ও সংকট সমাধানে ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণের বদলে কারো ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করে রাজনৈতিক সরকার। প্রশ্ন জাগে, এমন উদ্যোগে কি কোন সমস্যার সমাধান হয়, নাকি সংকটের মাত্রা আরও বাড়ে? দুঃখের বিষয় হলো, সাধারণত বলির পাঁঠা হয়ে থাকে দুর্বলরা, সংখ্যালঘুরা। এমন ভুল পদক্ষেপের কারণে সংকটের সমাধানতো হয়ই না, বরং মানুষ মজলুম হয়।

এখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মিডিয়ার ভূমিকা। মিডিয়া অনেক সময় বস্তুনিষ্ঠ হয় না, অনুসন্ধানী হয় না; বরং সরকার বা বিশেষ মহলের পক্ষে ভূমিকা পালন করে থাকে। মিডিয়ার এমন ভূমিকা দেশের সংবিধান, সম্পাদকীয় নীতিমালা জনস্বার্থ এবং ন্যায়ের সাথে সাংঘর্ষিক। মিডিয়ার এমন ভূমিকা দেশ, জনগণ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। মারাত্মক বিষয় হলো, বর্তমান সভ্যতায় মিডিয়ার কিছু মালিক নিজের স্বার্থে, রাজনৈতিক স্বার্থে, অর্থনৈতিক তথা বিজ্ঞাপন পাওয়ার স্বার্থে আপস করে চলেছে। এতে মিডিয়ার ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, সমাজের বিবেক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক সমাজও এইসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সঙ্গত ভূমিকা পালনে সমর্থ হচ্ছে না। তাঁরা এখন নানা কারণে, নানাভাবে বিভক্ত। ঐক্যের শক্তি হারালে এবং মেরুদণ্ড সোজা না থাকলে সাংবাদিক সমাজ কেন, কোন সমাজই সময়ের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। এমন বাস্তবতায় বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুর্বল মানুষদের এবং সংখ্যালঘুদের ওপর বঞ্চনা ও নিপীড়নের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন। এই পরিবর্তনে গণমাধ্যম কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে নৈতিক শক্তি এবং বিবেকের জাগরণ। তেমন জাগৃতির অপেক্ষায় আছে বিশে^র শোষিত-বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগণ।

আমরা জানি, বর্তমান সভ্যতার পেছনে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। তাদেরকে সভ্যতার শাসক হিসেবে অভিহিত করলেও ভুল হবে না। তাদের চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, জীবন-যাপন এবং পরিকল্পনা বিশেষভাবে প্রভাবিত করছে বর্তমান সভ্যতাকে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, সভ্যতার শাসকদের ব্যক্তিত্ব বিশ্ববাসীর ভালো-মন্দের জন্য অনেকাংশে দায়ী। তাই তাঁরা মানুষের দৃষ্টির সীমানায় থাকেন। মানুষ তাঁদের মূল্যায়ন করে থাকেন। আর এই মূল্যায়নটা বেশি হয় যে কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচনের সময়। প্রসঙ্গত আমরা এখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় বোন ম্যারিঅ্যান ট্রাম্প ব্যারির মূল্যায়ন তুলে ধরতে পারি। তিনি তাঁর ভাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘নীতিহীন’, ‘মিথ্যুক’ ও ‘নিষ্ঠুর’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

কোনোভাবেই তাঁর ভাই ট্রাম্পকে বিশ্বাস করা যায় না বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। ট্রাম্পের বড় ভাইয়ের মেয়ে ম্যারি ট্রাম্পের গোপনে রেকর্ড করা এক অডিও বার্তায় ম্যারিঅ্যানকে এসব কথা বলতে শোনা গেছে। অডিওটি ২০১৮-১৯ সালে রেকর্ড করেন ম্যারি। আর ২২ আগস্ট শনিবার এটি প্রকাশ্যে আসে। গত বছর মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাসীদের অনুপ্রবেশ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের বক্তব্য ও পদক্ষেপ নিয়ে অখুশি ছিলেন ম্যারিঅ্যান। সে সময় অভিবাসন প্রত্যাশী পরিবারের শিশুদের তাদের মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ম্যারিঅ্যান অডিওতে বলেন, ‘ওর (ডোনাল্ড ট্রাম্প) কোনো নীতি নেই। একদমই নেই। আর ওর মূল্যবোধ সম্পর্কে কী বলবো, হায় ঈশ্বর- আপনি যদি ধার্মিক হন, তাহলে আপনি চাইবেন কীভাবে মানুষকে সাহায্য করা যায়।’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৭৪ বছর বয়সী ট্রাম্পের কর্মকান্ডে হতাশ ম্যারিঅ্যান বলেন, ‘ওর যত্তসব ফালতু টুইট আর মিথ্যাচার, হায় ঈশ্বর। খুব বেশি সরাসরি হয়তো বলে ফেলছি কথাগুলো- ওর কথার ঠিক নেই। প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। মিথ্যাচার তো আছেই।’ উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি ট্রাম্পের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে তাঁর ভাইয়ের মেয়ে ম্যারি ট্রাম্পের লেখা ‘হাউ মাই ফ্যামিলি ক্রিয়েটেড ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ডেঞ্জারাস ম্যান’ শিরোনামের বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ম্যারি তার চাচা সম্পর্কে নানা তথ্য কোথায় পেয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যারি ট্রাম্প জানান, ২০১৮-১৯ সালের মধ্যে ম্যারিঅ্যান ট্রাম্প ব্যারির সঙ্গে তার কথোপকথনের ১৫ ঘণ্টার অডিও টেপ রয়েছে, যেগুলো তিনি গোপনে রেকর্ড করেছেন।

শনিবার রাতে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ম্যারির একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে লেখা ম্যারির বহুল আলোচিত বইটি প্রকাশিত হয় গত ১৪ জুলাই। বৃটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছিল, প্রকাশের প্রথম দিনেই বইটির প্রায় ১০ লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়। এই ম্যারি ট্রাম্প হলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বড় ভাই ফ্রেড ট্রাম্পের মেয়ে। বইটিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঔদ্ধত্য ও অবহেলার অনেক অভিযোগ তুলেছেন তিনি। বইটির প্রকাশ থামিয়ে দিতে নানা চেষ্টা চালিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু তারা সফল হয়নি।

মানুষ কি সব কাজে সফল হতে পারে? মানুষ যত বড় বা ক্ষতাবানই হোন না কেন, মানুষ তো মানুষই। মানুষের একটা সীমাবদ্ধতা থাকেই। সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে আছেন কেবল একজনই, তিনি আমাদের স্রষ্টা মহান প্রভু। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে মানুষ বোধ হয় তার সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে যায়। সে তখন ভুল কথা বলে, ভুল আচরণ করে।

দিনে দিনে এর মাত্রা বেড়ে যায়। এই বাড়াবাড়ি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবী কারো জন্যই কল্যাণকর বলে বিবেচিত হয় না। তখন সর্বত্রই লক্ষ্য করা যায় একটা প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়া সীমালংঘনকারীর পক্ষে যায় না। তখন তার আর করার কিছুই থাকে না। ট্রাম্পের পরিবারের সদস্যদের প্রতিক্রিয়া কি তেমন কিছু?

ইতিহাসের পাতায় দাম্ভিক শাসকদের করুণ পরিণতি লিপিবদ্ধ আছে। বর্তমান পৃথিবীতেও উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে কিছু দাম্ভিক শাসকের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতিহাস থেকে কি তাঁরা কোনো শিক্ষাই নেবেন না? দাম্ভিক শাসক ফেরাউন তো তার সেনাদলসহ সাগরে ডুবে মরেছিল। মহান স্রষ্টা কোনো কালেই জালেম ও দাম্ভিক শাসকদের পছন্দ করেননি।

https://dailysangram.com/post/425385