২৫ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার, ১১:২১

করোনাকালের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সরকারের করণীয়

ড. মো. নূরুল আমিন : Brac institute of Governance and Development (BIGD) Ges Power and participation Research Centre (PPRC) নামক দু’টি বেসরকারি সংস্থা সম্প্রতি করোনাকালে আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে পরিচালিত তাদের এক গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এই দু’টি সংস্থা এর আগে গত এপ্রিলে জরিপের মাধ্যমে মহামারি সময়ে আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর একটি গবেষণা চালায়। তখন লকডাউন বা সাধারণ ছুটি ছিল।

সাধারণ ছুটির পর কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে সেটা নির্ণয়ের জন্য গত ২০ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত তারা আরেকটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন। গত ১৮ আগস্ট মঙ্গলবার পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন তাদের গবেষণা রিপোর্ট জনসমক্ষে তুলে ধরেন। উল্লেখ্য যে, এই জরিপে ৭৬৩৮টি পরিবার অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি শহরের ৪৩ শতাংশ গ্রামের এবং ১.২২ শতাংশ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবার।

জরিপে দেখা গেছে যে, করোনার প্রভাবে ইতোমধ্যে ১৬% শহুরে বাসিন্দা ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে এবং নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ। ৫৪% গৃহকর্মী এ সময়ে কাজ হারিয়েছে। ৫৩% রিকশা চালকের আয় কমেছে। ৪৩% দরিদ্র মানুষের আয় কমেছে। আবার সরকারের নগদ সহায়তা পেয়েছে মাত্র ১৬% লোক; এর মধ্যে গ্রামে নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা মাত্রা ৩%।

জরিপে দেখা গেছে যে, করোনাকালে সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছে গৃহকর্মী বা কাজের বুয়ারা, দেশে এখন গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। এরপরই আসে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এ পেশার ৩৫ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে অদক্ষ শ্রমিক; তাদের কাজ হারানোর হার ৩১%।

সমীক্ষা অনুযায়ী করোনাকালে আয়ের উপর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রিকশা চালকদের। করোনার আগে একজন রিকশা চালকের নীট আয় যদি ১০০ টাকা হতো করোনাকালে সেটা ৪৬ টাকায় নেমে এসেছে। আয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর। তাদের আয় কমেছে ৫০ শতাংশ, এরপর আছে পরিবহন শ্রমিক।

জরিপের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, করোনাকালে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে গেছে ২১.৭ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ ৩ কোটি ৫৬ লাখ লোক যারা করোনা সংক্রমণের আগে দারিদ্র্যসীমার উপরে অবস্থান করছিলেন তারা দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে এসেছেন। করোনার আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিলো ২১% অর্থাৎ দেশে এখন দারিদ্র্যের হার প্রায় ৪৩ শতাংশ। জরিপে দেখা গেছে করোনার সময় সরকারের পক্ষ থেকে নগদ সহায়তার যে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল বেশিরভাগ লোক এখনো পর্যন্ত সেই সহায়তা পায়নি। মাত্র ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ এই সহায়তা পেয়েছে।

এর মধ্যে গ্রামের মানুষের হার হচ্ছে মাত্র ৩ শতাংশ। শহরের ৪৭ শতাংশ লোক বলেছে, লকডাউন তুলে দেয়া ছাড়া সরকারের হাতে কিছু করার ছিল না; গ্রামের ৩৭ শতাংশ লোক লকডাউনের ব্যাপারে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। জরিপের তথ্যানুযায়ী ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে শহুরে দরিদ্রদের আয় কমেছে ৪৩ শতাংশ, পক্ষান্তরে গ্রামের মানুষের আয় কমেছে ৪১ শতাংশ; পার্বত্য চট্টগ্রামের দরিদ্র মানুষের আয় কমেছে ২৫ শতাংশ।

করোনার কারণে মানুষের আয় হ্রাসের প্রতিফলন ঘটেছে তাদের খাবার গ্রহণের উপর। তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায় যে, ৩০ শতাংশ পরিবার অর্থাভাবে খাবার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। করোনার আগে তারা তিন বেলা খেতেন, করোনার সময় তা এক বেলা থেকে দু’বেলায় নেমে এসেছে। মার্চ থেকে শহরের নিম্নবিত্ত ও ৮০ ভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরা গোশত বা দুধ খেতে পারছে না। সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হয়েছে গোপন ক্ষিধা। এই অবস্থা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

বিআইজিডি ও পিপিআরসির গবেষণা প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশও রয়েছে। এতে বলা হয়েছে করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত যা আমাদের অর্থনীতির প্রায় ৮৫ শতাংশ, এই খাতকে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আনতে হবে। নতুন করে যারা দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে গেছে তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। সামাজিক সুরক্ষা খাতে যাদের সহযোগিতা করা হয় সেখানে সত্যিকারের দরিদ্র মানুষ নেই। এতে দরিদ্র মানুষের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের করোনাকালীন সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সম্যক প্রতিফলন হয়েছে বলে আমার মনে হয়, এতে প্রাপ্ত ফলাফল সরকার ও জনগণের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।

রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী করোনার আঘাতে নতুন করে ৩ কোটি ৫৬ লাখ লোকের দরিদ্র হবার বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এর অর্থ এত বছর ধরে আমরা যে উন্নয়নের বড়াই করে আসছি তার মধ্যে Sustainability বা টেকসই উন্নয়নের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না যার ফলে তা করোনার আঘাত সহ্য করতে পারেনি; মুখথুবড়ে পূর্ববর্তী দারিদ্র্য অবস্থায় ফিরে গেছে। এর ফলে দারিদ্র্যের হার ২০১৮ সালের ২১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৩ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। এই সাথে চরম দারিদ্র্যের হারও বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

বিবিএস পরিচালিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী (LFS) বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম জনসংখ্যার পরিমাণ হচ্ছে ৬ কোটি ৩৫ লক্ষ। এর মধ্যে ৬ কোটি ৮ লক্ষ লোক বিভিন্ন খাতে কাজে নিয়োজিত রয়েছে। বাকী ২৭ লক্ষ লোক বেকার। গবেষণায় প্রাপ্ত ৩ কোটি ৫৬ লক্ষ লোক নতুন করে দরিদ্র হবার অর্থ হচ্ছে তারা তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে এবং বেকার হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে গৃহকর্মীরাও আছে। আমাদের কাজ হচ্ছে খাত ও পেশাওয়ারী এই লোকগুলোকে বের করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং প্রণোদনার অন্তর্ভুক্ত করা। হিসাব করলে বেকারের সংখ্যা এখন মোট কর্মক্ষম লোকের ৬০.৩১ শতাংশ দাঁড়ায়।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা এবং পেশা নির্বিশেষে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি প্রণোদনা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। দুঃখের বিষয় শতকরা ৮৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত লোক সরকারের এই নগদ সহায়তা পায়নি। আবার গ্রামাঞ্চলে এই সহায়তা প্রাপ্ত লোকের সংখ্যা হচ্ছে মাত্র শতকরা ৩ জন। দরিদ্র মানুষের প্রণোদনা কোথায় গেল তা সরকারকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে কর্মসংস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সংবিধানের ২০(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তৃত্ব এবং সম্মানের বিষয় এবং প্রত্যেকের নিকট থেকে যোগ্যতা অনুসারে ও প্রত্যেকের কর্মঅনুযায়ী- এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।” এ প্রেক্ষিতে বেকার সমস্যা হ্রাস আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার নির্ধারণ অত্যন্ত কঠিন কাজ। পাশ্চাত্যে যে ভিত্তিতে বেকারের হার নির্ধারণ করা হয় সে ভিত্তি এখানে অচল। এখানে যারা সপ্তাহে এক ঘণ্টার জন্যও কাজ করেননি অথচ সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছিলেন শুধু তাদেরই বেকার বলে গণ্য করা হয়। এখানে পাশ্চাত্যের ন্যায় কোনও বেকার ভাতা নেই, সামাজিক নিরাপত্তা জালের (Social Safety Net) বেষ্টনিও সীমিত, তাই অনেককেই বেঁচে থাকার জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতে কিছু করতে হয়। বর্তমানে এই সুযোগও নেই। করোনা আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক সব খাতের সুযোগসুবিধাকেই সংকুচিত করে দিয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছ বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের কর্মচ্যুতি এবং দেশে প্রত্যাবর্তন, ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী আমাদের দেশে মোট কর্মে নিয়োজিতদের মধ্যে প্রধান অংশ আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত যা প্রায় ৪৪.৩ শতাংশ। চাকরিজীবী ও পারিবারিক শ্রমে নিয়োজিতদের হার যথাক্রমে ৩৯.১ শতাংশ ও ১১.৫ শতাংশ। করোনাকালে কর্মসংস্থানের এই অবস্থা লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে। ফলে এখন বেকারত্বের হার ৬০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এর সাথে যদি প্রচ্ছন্ন ও ছদ্মবেশী বেকারত্বকে যোগ করা হয় তা হলে এই হার ৭০ শতাংশের বেশী হবে।

উপরোক্ত আলোচনার সাথে যদি বাংলাদেশের বেকারত্ব ও ছদ্মবেশী বেকারত্বের হারের পাঁচ বছরের গড় মিলিয়ে দেখা হয় তা হলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারত্বের হার ২৪.৩ শতাংশ, সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার ৪৩ শতাংশ যা করোনাকালে ৭০ শতাংশে উপনীত হয়েছে। ১৯৩০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ছিল ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এই পরিস্থিতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে Great Depression বা মহামন্দা বলা হয়ে থাকে। সরকারি তথা বিবিএস পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের শ্রম বাজারে এখন মহামন্দা বিরাজ করছে। করোনাকালের ওপর পরিচালিত সমীক্ষা

এই ধারণাকে আরো দৃঢ় করেছে। অবশ্য দু’টি কারণে আমরা এতদিন বেকার সমস্যার তীব্রতা অনুভব করিনি।
প্রথমত ৯০ লাখ থেকে এক কোটি বাংলাদেশী দেশের বাইরে কর্মরত ছিল; এই বিপুল জনসংখ্যার জন্য দেশে কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হয়নি। দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে দেশে অনেক নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল।

করোনার কারণে কর্মচ্যুত হয়ে অনেক দেশ থেকে প্রবাসীরা খালি হাতে এখন দেশে ফিরছেন। করোনার ফলে স্থবিরতা সৃষ্টি হওয়ায় দেশে এখন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হারও অনেক হ্রাস পেয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। দেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সকল অসহায় ও বেকারদের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। দেশজ প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন ও কর্মসংস্থান (Production and Employment) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরিস্থিতি অনুকূলে না আসা পর্যন্ত অনুৎপাদনশীল অবকাঠামো নির্মাণ খাতের মেগা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন স্থগিত রাখতে হবে। সরকার জাতীয় স্বার্থে বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।

https://dailysangram.com/post/425184