২১ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২৪

শেয়ারবাজারের টাকায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ

উদ্যোক্তাদের দায় চাপছে বিনিয়োগকারীদের ওপর

 শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানিই শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যাংক ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপাচ্ছেন। গত তিন বছরে অনুমোদন পাওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২৩টি কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে প্রায় ৬শ’ কোটি টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ শোধ করেছে। এ সময়ে কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজার থেকে ১ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। অর্থাৎ বাজার থেকে সংগ্রহ করা মূলধনের প্রায় অর্ধেকই ব্যাংকের দায় পরিশোধে ব্যয় হয়েছে। এতে যে উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করা অর্থাৎ কোম্পানিগুলোর আয় বৃদ্ধি- তা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের কাজ যৌক্তিক নয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মো. রকিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশে শিল্পায়নের জন্য আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) অনুমোদন জরুরি। কিন্তু শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। তার মতে, যেসব কোম্পানি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর শোধ করতে পারছে না, ওই কোম্পানিই শেয়ার বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করছে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা তাদের ঋণের দায় বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপাচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক ঋণ পরিশোধে আইপিওর অনুমোদন না দিতে স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি সংগ্রহের উদ্দেশ্য হল- কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি। শেয়ারবাজারে আসার আরেকটি উদ্দেশ্য হল- কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দেয়া। বিশ্বব্যাপী এ ধারণা থেকেই শেয়ারবাজারের জন্ম। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম। পুঁজি বা মূলধন সংগ্রহের পর বেশির ভাগ কোম্পানিই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে। অর্থাৎ উদ্যোক্তারা আগে ঋণ নিয়ে যে দায় সৃষ্টি করেছেন, তা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের ওপর। এতে কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। আর আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় কোম্পানিগুলো এর দায় থেকেও পার পেয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, গত তিন বছরে শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা ২৩টি। এসব কোম্পানি প্রিমিয়ামসহ বাজার থেকে ১ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক পরিশোধে ব্যয় করেছে ৫৯৩ কোটি টাকা। কোম্পানিগুলোর মধ্যে শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রি ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, প্যাসেফিক ডেনিমস ২৫ কোটি টাকা, ডরিন পাওয়ার ১৯ কোটি টাকা, ইনফরমেশন টেকনোলজি ৪ কোটি, কেডিএস এক্সেসরিজ ৭ কোটি, আমান ফিড ৫ কোটি, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং ২০ কোটি ৪০ লাখ, শাশা ডেনিম ১৮ কোটি ২২ লাখ, সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল ৪৫ কোটি ৩১ লাখ, হামিদ ফেব্রিকস ৩১ কোটি, খান ব্রাদার্স পিপি ২ কোটি, ওয়েস্টার্ন মেরিন ১৩০ কোটি, রতনপুর স্টিল রি-রোলিং ৭৫ কোটি টাকা, সুরিদ ইন্ডাস্ট্রিজ ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ফারইস্ট নিটিং ৫৪ কোটি ২ লাখ টাকা, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিল ২৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা, তুং হাই নিটিং ১৬ কোটি, খুলনা প্রিন্টিং ৩০ কোটি টাকা, শাহজিবাজার পাওয়ার ৩১ কোটি ৭০ লাখ, পেনিনসুলা চিটাগং ১৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং এমারেল্ড অয়েল ২০ কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করেছে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আইপিওর সব টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ সঠিক নয়। এটি বিএসইসিকে নজরদারি করতে হবে। তার মতে, অনেক কোম্পানি আছে আইপিওর টাকা অন্য খাতে খরচ করে। এতে কোম্পানির আয় বাড়ে না। বিষয়টি তদন্ত করে বিএসইসিকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
জানা গেছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর অনেক কোম্পানিরই আয় কমছে। ২০১১ সালে মবিল যমুনা তালিকাভুক্ত হয়। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারে প্রিমিয়ামসহ ১১৫ টাকা নেয়া হয়। তালিকাভুক্তির আগে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৩ টাকা ৬২ পয়সা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালে রিস্টেট ধরেই প্রতিষ্ঠানটির ইপিএস ৩ টাকা ০৭ পয়সায় নেমে আসে। ২০১২ সালে ইপিএস ছিল ২ টাকা ৭৩ পয়সা এবং ২০১৩ সালে ২ টাকা ৯৩ পয়সা। এছাড়া একই বছরে ১০ টাকার শেয়ার ১০১ টাকায় বাজারে তালিকাভুক্ত হয় এমআই সিমেন্ট। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটির ইপিএস ছিল ৪ দশমিক ০৭ টাকা। পরের বছর তা ১ টাকা ৮৭ পয়সায় নেমে এসেছে। ২০১২ সালে ১০ টাকার শেয়ারে আরও ৫০ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৬০ টাকায় বাজারে তালিকাভুক্ত হয় ওরিয়ন ফার্মা। ওই বছর প্রতিষ্ঠানটির ইপিএস ছিল ৬ টাকা ০২ পয়সা। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে তা কমে ৪ টাকা ০৬ পয়সায় নেমে এসেছে। ২০১১ সালে বাজারে আসে আমরা টেকনোলজি। ওই বছর কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ২ টাকা ৬৩ পয়সা। কিন্তু ২০১২-তে ২ টাকা ৪৬ পয়সায় নেমে আসে। ২০০৭ সালে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ১৪ টাকা ১৯ পয়সা। পরের বছর নেমে আসে ১০ টাকা ৫৫ পয়সায়। আর্গন ডেনিমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। ২০১১ সালের ৫ টাকা ৪৬ পয়সার ইপিএস ২০১২ সালে নেমে এসেছে ৪ টাকা ৫১ পয়সায়। বেঙ্গল উইন্ডসর থার্মো প্লাস্টিকের ২০১১-১২ সালের ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৫৬ পয়সা। ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এর ইপিএস দাঁড়িয়েছে ২ টাকা ৩১ পয়সা। তালিকাভুক্তি নিয়ে নানা ঘটনার জন্ম দেয় অ্যাপোলো ইস্পাত। কোম্পানিটি ১২ টাকা প্রিমিয়ামসহ ২২ টাকা আইপিও মূল্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু তালিকাভুক্তির পরপরই কোম্পানির ইপিএস কমতে থাকে। একইভাবে কমছে মোজাফ্ফর হোসাইন স্পিনিং মিলস, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং এবং এমারেল্ড অয়েলের ইপিএস।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক। কারণ ব্যাংক ঋণ শোধের পর কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অবশ্যই ভালো হওয়ার কথা। তিনি বলেন, ঋণ শোধ হলে তার দায় কমে। এতে মুনাফা বাড়ে। কিন্তু আয় কমলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/21/110765/