২৮ জুন ২০২০, রবিবার, ১১:৩৯

সাত নদীর পানি বিপদসীমার উপরে

উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা

নদীগর্ভে বিলীন তিন শতাধিক বাড়ি * পানিবন্দি আড়াই লাখ মানুষ * আমনের বীজতলাসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি * কোথাও কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকেছে পানি

দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে একযোগে বন্যা শুরু হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এই বন্যার ঢেউ লাগতে পারে দেশের মধ্যাঞ্চলেও। ভারতের পূর্বাঞ্চল বা উজান থেকে নেমে আসা পানি, অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এ বন্যা দেখা দিয়েছে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তা চলতে পারে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধরলা, সুরমা, কুশিয়ারা, যদুকাটাসহ ৯টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। সোমেশ্বরী, ভুগাই ও কংস ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় বিপদসীমা পার করবে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীভাঙনও তীব্র আকার ধারণ করেছে। নদীতীরবর্তী এলাকায় তিন শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় সড়কও ভেঙে গেছে। আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় বন্যাকবলিত মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ অথবা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে। আমনের বীজতলাসহ পাট, ভুট্টা, কাউন ও শাকসবজির ক্ষেত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) বলেছে, ইতোমধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, জামালপুর, সিলেট ও সুনামগঞ্জ বন্যাকবলিত হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সিরাজগঞ্জ ও বগুড়াও আক্রান্ত হবে। সবমিলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং ভারতের মেঘালয়, আসাম, দার্জিলিংসহ পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় আগামী তিনদিন ব্যাপক বৃষ্টিপাত হতে পারে। ফলে নদ-নদীতে পানিপ্রবাহ আরও বেড়ে যেতে পারে। এসব মিলে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যা হতে পারে। অর্থাৎ বন্যার মেয়াদ ১৫ দিনও হতে পারে। এ বন্যার পানি একদিকে মেঘনার দিকে এবং আরেকদিকে যমুনা হয়ে পদ্মায় আসতে পারে। এতে মধ্যাঞ্চল বা ঢাকা, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের নিম্নাঞ্চল বন্যাকবলিত হতে পারে।

এফএফডব্লিউসির বুলেটিনে বলা হয়, উল্লিখিত নদীগুলোয় বাড়তে পারে পানি প্রবাহ। ফলে উল্লিখিত জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। বর্তমানে বিপদসীমার সবচেয়ে উপরে বইছে যদুকাটা লরেরগড় পয়েন্টে ১২১ সেন্টিমিটার উপরে। ধরলায় বইছে ৪১ সেন্টিমিটার, তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে ১৮ সেন্টিমিটার, ব্রহহ্মপুত্র নুনখাওয়া ও চিলমারিতে যথাক্রমে ২১ ও ৩৫ সেন্টিমিটার উপরে বইছে। যমুনা ফুলছড়ি ও বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ২৫ ও ১৮ সেন্টিমিটার উপরে এবং সুরমা কানাইঘাটে ৪০ ও কুশিয়ারা সুনামগঞ্জে ৪৬ সেন্টিমিটার উপরে বইছে। যুগান্তর ব্যুরো, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

কুড়িগ্রাম, চিলমারী, নাগেশ্বরী ও উলিপুর : কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটেছে। শনিবার দুপুরে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৩৮ সেমি. এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে ২৪ সেমি. বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলার ২৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। কুড়িগ্রামেও নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছে ২ শতাধিক পরিবার। যাত্রাপুর ইউনিয়নের চরযাত্রাপুর এলাকার অধিকাংশ বাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করছে। এ গ্রামের আবুল হোসেন ও মোজাম্মেল হক বলেন, চরের আবাদ সব নষ্ট হয়েছে। বাড়ির চারপাশে যারা সবজি লাগিয়েছেন সেগুলো এখন পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়াও নিচু লেট্রিন ডুবে যাওয়ায় বিপদে পড়েছে নারী ও শিশুরা। এদিকে প্রচণ্ট নদীভাঙনের মুখে পড়েছে উলিপুর উপজেলার হাতিয়া, থেতরাই, বুড়াবুড়ি, বেগমগঞ্জ এলাকার মানুষ। ভাঙছে রৌমারীর কর্ত্তিমারী, চিলমারীর নয়ারহাট, কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসা ও সারডোব এলকায়। চিলমারীতে নিম্নাঞ্চলের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমর, গঙ্গাধর, শংকোষসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে দু’কূল ছাপিয়ে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে ঢুকতে শুরু করে লোকালয়ে। উলিপুরে
৮টি ইউনিয়নের প্রায় ২১ হাজার পরিবারের মানুষজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, শুক্রবার ভাঙনকবলিত উপজেলায় ৩০২ টন চাল ও ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে শনিবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ৩৫ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৪ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অপরদিকে ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে শনিবার বিকাল ৩টায় বিপদসীমার ৩ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া তিস্তা নদীর পানি সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদরের পুরাতন পয়েন্টে সকাল ৬টায় বিপদসীমার ১৫ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সুন্দরগঞ্জের ৭টি ইউনিয়ন, গাইবান্ধা সদরের ৩টি, ফুলছড়ির ৬টি ও সাঘাটার ৩টি ইউনিয়নে ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় প্রায় ১৫ হাজার লোক এখন পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গত কয়েকদিনে উত্তর খাটিয়ামারী বাজারের মহিলা মার্কেট, দক্ষিণ খাটিয়ামারী গ্রামের একটি কালভার্ট, কয়েকটি গ্রামের লোকজনের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

ডিমলা (নীলফামারী) : ডালিয়া পয়েন্টে টানা দুইদিন তিস্তার পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কখনও ২ সেন্টিমিটার কমলে কিছুক্ষণ পর আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার বন্যার কারণে ভাঙনের কবলে পড়ে ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ৩০ পরিবারের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বলে ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান দাবি করেন।

রংপুর, গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া : তিস্তার নদীভাঙন ও পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীরবর্তী এলাকার মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তিস্তার চরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে পাঁচশতাধিক পরিবার। একই সঙ্গে নদীর ভাঙনের ফলে বিনবিনার চর থেকে তুষভাণ্ডারগামী পাকা সড়কটির প্রায় তিনশ’ মিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন অব্যাহত থাকলে তুষভাণ্ডারের সঙ্গে চরাঞ্চলের লোকজনের যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। রংপুরের গঙ্গাচড়ায় তিস্তার পানি ১৫ সেন্টিমিটার বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডালিয়া ব্যারাজের সবকটি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার চরাঞ্চলের ৭ শতাধিক বাড়ির মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। কাউনিয়ায় তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের মানুষ।

লালমনিরহাট : লালমনিরহাটের ৩ উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। শনিবার হাতীবান্ধা উপজেলায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়াও ধরলা নদীর পানিও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার হাতীবান্ধা, আদিতমারী ও সদর উপজেলার নদীতীরবর্তী এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানির তোড়ে গত দুইদিনে লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ড এলাকায় অন্তত ২০টি বসতবাড়ি নদীগর্ভে চলে বিলীন হয়ে গেছে। ওই এলাকার কেউ কেউ নদীর হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিরাপদে চলে যাচ্ছেন। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানান, পানিবন্দি পরিবারগুলোর জন্য ৮০ টন চাল ও ৬ লাখ ২৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

সুনামগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার : ছাতকে সর্বত্র বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার ৩টি নদী, খালবিল ও হাওরে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১৩টি ইউনিয়নের প্রায় লাখো মানুষ। সুরমা নদীর পানি শনিবার দুপুরে বিপদসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে শহর ও শহরতলির নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলীয় এলাকার বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করছে। দোয়ারাবাজারের ৭ ইউনিয়নের ৫০ গ্রাম প্লাবিত হওয়ায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সুরমা, চেলা, মরা চেলা, খাসিয়ামারা, চিলাই, কালিউরি ও ছাগলচোরাসহ সব নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিলেট : সিলেটের সবকটি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। পানি বাড়ার কারণে নদী তীরের তিনটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে সারি-গোয়াইনঘাট সড়কসহ গ্রামীণ অনেক সড়ক। এ কারণে শুক্রবার বিকাল থেকে উপজেলা সদরের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ।

বকশীগঞ্জ ও দেয়ানগঞ্জ (জামালপুর): যমুনার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ সেমি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩০ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন সংলগ্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। বকশীগঞ্জ উপজেলার দুইটি ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার আশঙ্কা করছেন নদীপারের মানুষ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/320284/