উত্তরায় ডিপিএস স্কুলের সামনে অভিভাবকদের মানববন্ধন
২৪ জুন ২০২০, বুধবার, ১:৪৮

নামকরা স্কুলের চাপই বেশি

সন্তানের টিউশন ফি দিতেই নাভিশ্বাস

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তিন মাসের বেশি সময় ধরে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে না। অপরদিকে অভিভাবকদের অনেকের চাকরি নেই। আবার চাকরি থাকলেও অনেকে বেতনভাতা পাচ্ছেন না। কারও আবার ব্যবসা-বাণিজ্যও নেই। সব মিলে বেশির ভাগ অভিভাবকের আয় শূন্যের দিকে।

পরিবারের ভরণপোষণে তাদের ত্রাহী অবস্থা। এমন অবস্থা বিবেচনায় ছুটির দিনগুলোয় টিউশন ফি আদায় না করতে শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অভিভাবকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান যত বড়, চাপও তাদের তত বড়। কোনো কোনো স্কুল কর্তৃপক্ষ শ্রেণিশিক্ষকদের লাগিয়ে দিয়েছেন অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের পেছনে।

আবার শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের লিঙ্ক না দেয়া, রেজাল্ট প্রকাশ না করাসহ বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে কোনো কোনো স্কুল। টিউশন ফি পরিশোধের চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। এ দুঃসময়ে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজপথে নেমেছেন ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে দিল্লি পাবলিক স্কুলের (ডিপিএস) অভিভাবকরা মানববন্ধন করেছেন। এর আগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অভিভাবকরা একই কর্মসূচি পালন করেন। রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের অভিভাবকরা গণমাধ্যমে ইমেইল করে নানা অভিযোগ জানিয়েছেন।

অভিভাবকরা বলেন, অসাধু শিক্ষক ও স্কুলের কাছে তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। অতীতে অপ্রয়োজনে শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট-কোচিং করতে হয়েছে। আয় স্বাভাবিক থাকায় তারা এসব অবৈধ দাবি ও চাপ মেনে নিয়েছেন। কিন্তু এ দুঃসময়ে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের উভয়পক্ষকেই আমরা সহনীয় আচরণ করার অনুরোধ করব। এ কথা ঠিক যে, টিউশন ফি দিয়ে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা হয়। কিন্তু এ সময়ে অভিভাবকদের ওপর চাপ সৃষ্টি কাম্য নয়। আবার এটার অজুহাতে শিক্ষকদের বেতন না দেয়াও গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে টিউশন ফির জন্য চাপ দিচ্ছে না। বিপরীত দিকে তারা শিক্ষকদের বেতনভাতা ঠিকমতো দিয়ে যাচ্ছেন।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু যুগান্তরকে বলেন, করোনাকালের বিশেষ পরিস্থিতিতে আমরা দেশের সব শিক্ষার্থীর ছয় মাসের টিউশন ফি মওকুফ করার ব্যবস্থা নিতে ১০ জুন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়ে ইমেইলে পাঠিয়েছি। সরকার হয়তো ব্যবস্থা নেবে।

কিন্তু মানবিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে যেখানে দুঃসময়ে স্কুলগুলোরই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে টিউশন ফি মওকুফ করে দেয়ার কথা সেখানে চাপ সৃষ্টি অন্যায়। তবে আমাদের এ দাবির আগেই মাস্টারমাইন্ডসহ কয়েকটি স্কুল শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি ৫০ শতাংশ মওকুফ করেছে। এ পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই।

মানববন্ধনকালে অভিভাবকরা জানান, দিল্লি পাবলিক স্কুলে সীমিত আকারে অনলাইনে ক্লাস চলছে। এ কারণে তারা ৫০ শতাংশ টিউশন ফি দিতে আগ্রহী। তবে এটা সবার ক্ষেত্রে নয়। যেসব অভিভাবকের আর্থিক সংকট চলছে কেবল তাদের মওকুফ করার দাবি করছি। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ অমানবিক আচরণ করছে। প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবক ফোরামের সভাপতি ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ইমেইলে অভিভাবকদের হুমকি দেয়া হচ্ছে, রেজাল্ট প্রকাশ করা হবে না। ও লেভেল এবং এ লেভেল পরীক্ষার নম্বর ইংল্যান্ড থেকে স্কুলের কাছে ছেড়ে দিয়েছে। সেটি না দেয়ার হুমকিও দেয়া হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের লিঙ্ক দেয়া হচ্ছে না।

রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে ১ জুন থেকে আগামী জুলাই পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সব বেতন পরিশোধের তাগিদ দেয়া হয়েছে। শুধু বিকাশে এ অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। ২৪ জুনের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাতিল করা হবে বলে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তায় জানানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ৯ এপ্রিল থেকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। নাম প্রকাশ না করে ওই কলেজের একাধিক অভিভাবক এ তথ্য জানান।

এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, নিজ অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় টিউশন না নিলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য ফি চাওয়া হয়েছে। তবে চাপ দেয়া হচ্ছে না। অভিভাবকদের সমস্যা বিবেচনা করে বিভিন্ন হারে মওকুফ করা হচ্ছে। কেউ সময় চাইলে সেটাও দেয়া হচ্ছে। এ বছর ২৫ লাখ টাকা ফি মওকুফ করা হয়েছে।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরা জানান, টিউশন ফি আদায় করতে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনে এ সংক্রান্ত খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে। টিউশন ফি পরিশোধ করা না হলে অনলাইন ক্লাস থেকে বহিষ্কার ও পরবর্তী ক্লাসে উন্নীত করা হবে না বলে শ্রেণিশিক্ষকদের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফি আদায় করতে না পারলে বেতন দেয়া হবে না বলেও শিক্ষকদের জানানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, তিন মাস পর পর টিউশন ফি পরিশোধ করার নিয়ম আছে। কিন্তু অনেকে চার থেকে পাঁচ মাসের বেতন পরিশোধ করেননি। এ কারণে বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রমী অবস্থান নিয়েছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ। প্রতিষ্ঠানটি এখন শুধু ফেব্রুয়ারি ও মার্চের ফি জমা দিতে অভিভাবকদের এসএমএস পাঠিয়েছে। চার মাসের ফি পরে নেবে। তবে দুই মাসের বেতনের সঙ্গে ডায়েরি, সিলেবাস, বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালন, পরীক্ষার খাতাসহ বিভিন্ন ফি বেতনের সঙ্গে পরিশোধ করতে হবে। এতে অভিভাবকরা আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচি স্থগিত ছিল। সেখানে এ খাতে অর্থ দাবি করা চাঁদাবাজির শামিল। তারা চার মাসের ফি মওকুফের দাবি করেছেন।

এ ব্যাপারে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া বলেন, বিভিন্ন ক্লাসের সহস্রাধিক ছাত্রীর বেতন ফ্রি করে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় সব শিক্ষার্থীর ফি মওকুফ করা হলে শিক্ষকদের বেতন দেয়া যাবে না। তাই অভিভাবকদের বিষয়টি মাথায় রেখে ফি পরিশোধ করা দরকার।

এভাবে রাজধানীর মনিপুরসহ আরও বেশকিছু স্কুল টিউশন ফি পরিশোধে অভিভাবকদের এসএমএস দিয়েছে। আবার উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে অভিভাবকদের কোনো চাপ দিচ্ছে না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/318979/