১৩ মে ২০২০, বুধবার, ১২:৩০

নমুনা পরীক্ষায় দক্ষ জনশক্তির অভাব

পিছিয়ে সরকারি ল্যাব

দক্ষ জনশক্তি ছাড়া সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব নয় -বিএসএমএমইউ উপাচার্য * নমুনা সংগ্রহে ১১ দফা সুপারিশ এনআইএলএম পরিচালকের * পরীক্ষা বাড়াতে না পারলে সংক্রমণের সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না

দক্ষ জনশক্তির অভাবে সরকারি ল্যাবরেটরিগুলো করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির মুখে ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের চিন্তা করা হলেও, তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজারের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে এ সংখ্যা। এটা বাড়াতে না পারলে সংক্রমণের সঠিক পরিস্থিতি বোঝা যাবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৩৮টি পিসিআর ল্যাবে কোভিড-১৯ শনাক্ত পরীক্ষা কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সোমবার থেকে শুরু করেছে। এসবের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ল্যাব আছে ১০টি।

বাকিগুলো স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে স্থাপিত। এগুলোই মূলত সরকারি ল্যাব হিসেবে পরিচিত। ২ মাস আগে নমুনা পরীক্ষা শুরুর পর একটির জায়গায় এখন ৩৮টি ল্যাবে কাজ চলছে।

প্রায় প্রতিটি ল্যাবরেটরির ওপর নির্ভর করছে কয়েকটি জেলা-উপজেলার বিশাল সংখ্যক মানুষের পরীক্ষা। এরপরও সরকারি ল্যাবগুলোয় সক্ষমতার তুলনায় কম পরিমাণে কোভিড-১৯ রোগীর নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ল্যাবগুলো। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দক্ষ জনশক্তির অভাবেই বেশিরভাগ ল্যাবের সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করা হচ্ছে না।

এতে সংগৃহীত অনেক নমুনা পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হচ্ছে। তবে এ সমস্যা সমাধানে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, ল্যাবে দক্ষ জনশক্তি থাকতে হবে। তাহলেই স্বল্প পরিসরে অধিক নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা সম্ভব। আমাদের ল্যাবের প্রধান থেকে শুরু করে সর্বস্তরের কর্মী দক্ষ হওয়ায় আমরা অন্য অনেক ল্যাবের তুলনায় অধিক নমুনা পরীক্ষা করতে পেরেছি। তিনি জানান, বর্তমানে তাদের দুটি পিসিআর মেশিনে পরীক্ষা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় থেকে আরও একটি মেশিন দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সেটি এলে আরও বেশি পরিমাণে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা সম্ভব হবে।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) দুটি পিসিআর ল্যাবে গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৪১১টি, আইসিডিডিআর,বিতে ৪২১টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে ২০৬টি, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ২৯২টি, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে ২৫৪টি এমকি নারায়ণগঞ্জে সম্প্রতি স্থাপিত গাজী কোভিড-১৯ পিসিআর ল্যাবে ১০০টি পরীক্ষা করা হয়েছে।

অন্যদিকে সরকারি ল্যাবগুলোর মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ১২৬টি, মুগদা মেডিকেল কলেজে ০টি, কুর্মিটোলায় ৩৩টি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৮৭ এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে ৬১টি, ওসমানী মেডিকেল কলেজে ১৯টি, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে ৬১টি। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিনের রেফারেল সেন্টার ৫০৪টি এবং আইপিএইচ ৭৫০টি নমুনা পরীক্ষা করেছে।

এখানে সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার প্রার্থক্য ফুটে উঠেছে। ঢাকায় সব ল্যাবরেটরিতে এ পর্যন্ত ৯১ হাজার ৯১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে হয়েছে ৪৫ হাজার ৫৪৭টি নমুনা পরীক্ষা। এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৩৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ৬৬০ জন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি হাসপাতালে স্থাপিত পিসিআর ল্যাবের অধিকাংশই নতুন। এগুলো পরিচালনার মতো দক্ষ লোকবলের ঘাটতি আছে। এছাড়া মাঠ থেকে নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিভ্রান্তি আছে। যেমন, দক্ষ টেকনোলজিস্ট না থাকায় যথাযথভাবে নমুনা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে এদের মাঠে নামিয়ে দেয়ায় মুখ থেকে লালা সংগ্রহের পরিবর্তে থুতু নিয়ে আসছে।

ল্যাবরেটরি চালানোর ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞ লোকের অভাব প্রকট। এ অবস্থায় ল্যাবের সক্ষমতা থাকলেও সঠিক নমুনার অভাবসহ অন্যান্য কারণে পরীক্ষা বাড়ানো যাচ্ছে না। এছাড়া পরীক্ষা এবং এর রেজাল্ট হাতে পাওয়ার ক্ষেত্রে আছে নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। নমুনা দেয়া থেকে শুরু করে ফল পাওয়া পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে তদবির করতে হয়। দিনের পর দিন ঘুরে সব সময় ভালো ফলও পাওয়া যায় না। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ এবং হতাশ।

তারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার আগ্রহও হারিয়ে ফেলছেন। এসব কারণে সরকারি ল্যাবগুলো পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে। তাদের হাতে আছে দক্ষ জনবল। অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে কাজ করিয়ে তারা সুফল পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে নমুনা পরীক্ষা ও শনাক্তের যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়, তার মধ্যে বড় একটি অংশ স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ল্যাব থেকে তথ্য জোগান দেয়া হয়। যে কারণে আগের চেয়ে নমুনা পরীক্ষা এবং শনাক্তের সংখ্যাও বেড়েছে।

মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বিত কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৩৮টি পিসিআর ল্যাবে কোভিড-১৯ শনাক্ত পরীক্ষার কার্যক্রম চলছে। এসব ল্যাবে গত ২৪ ঘণ্টায় ৬ হাজার ৭৭৩ জনের কোভিড-১৯ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। ৯৬৯ জন নতুন রোগীসহ এ পর্যন্ত শনাক্ত ১৬ হাজার ৬৬০ জন। এ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ২৫০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪৫ জনসহ এ পর্যন্ত সুস্থ ৩১৪৭ জন। তিনি জানান শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ১৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫০ শতাংশ।

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের প্রস্তাবে নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধির বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, কোভিড-১৯ শনাক্তকরণে সারা দেশে ৩৫টির অধিক ল্যাবরেটরিতে রিয়েল টাইম পিসিআর পরীক্ষা চালু আছে। একেকটি ল্যাবরেটরিতে কোন অঞ্চল বা জেলা থেকে নমুনা আসবে তাও অধিদফতর নির্ধারণ করে দিয়েছে। বেশিরভাগ ল্যাবরেটরিতেই পিসিআর যন্ত্রের সংখ্যা ১টি। যদি ৮ ঘণ্টার এক শিফট করে পরীক্ষা কাজ চালানো হয়, তবে ১টি পিসিআর ল্যাব ৯০ বা ততোধিক নমুনার ফলাফল দিতে পারে।

যদি ২টি শিফট চালু করা হয় তবে আরও ৯০টি অর্থাৎ ১৮০ বা ততোধিক রিপোর্ট দেয়া সম্ভব। কিন্তু ওই ল্যাবরেটরিকে নির্দিষ্ট করে দেয়া অঞ্চলগুলো থেকে দৈনিক গড়ে ৩০০-র অধিক নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয়। অনেক ল্যাবরেটরিতে জনবল সংকট থাকার জন্য তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী পরীক্ষা কাজ সম্পাদন করা যাচ্ছে না। বাইরের অনেক ল্যাব এ০ ক্রান্তিকালে কোভিড-১৯ ডায়াগনসিস সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

শুরু থেকে পিসিআর করে আসা কেন্দ্রীয় পর্যায়ের ল্যাবরেটরি হঠাৎ করে সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক নমুনা পরীক্ষাধীন অবস্থায় বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে জমা হয়ে আছে। এসব সমস্যা সমাধানে- ১। কার্য সম্পাদনের তালিকা থেকে উচ্চ হারে সম্পাদনকারী ল্যাবগুলোয় যন্ত্রপাতি ও জনবল বৃদ্ধি করে তাদের সক্ষমতা পুরোটাই ব্যবহারের সুয়োগ দেয়া; ২। যেসব ল্যাবরেটরি এখন এক শিফট কাজ করছে তাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সার্বক্ষণিক ল্যাব চালুর ব্যবস্থা;

৩। প্রতিটি ল্যাব দিনের শেষে তাদের কত নমুনা জমা থাকল তার সংখ্যা অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে জানিয়ে দিয়ে সেইমতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নমুনা পরিবহনে যে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সেটিকে আরও সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী করে প্রতিদিনের নমুনা প্রতিদিন অধিদফতর থেকে নির্ধারিত ল্যাবগুলোয় পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কয়েকদিন পরপর জমে থাকা নমুনা পরিবহনের ব্যবস্থা বন্ধ করা প্রয়োজন;

৪। প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রাইভেট পর্যায়ে রিয়েল টাইম পিসিআর পরিচালনা করার আয়োজন রয়েছে এরকম ল্যাবরেটরিগুলো মানবিক কারণে কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের কাজে সম্পৃক্ত করতে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে; ৫। বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে কাজ করতে আগ্রহী দক্ষ জনবলের জন্য কর্মস্থল নির্ধারণ করে দিতে হবে;

৬। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিজ কর্মপরিধির মধ্যে কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার ব্যাপারে নজরদারি ও পরিবীক্ষণ আক্ষরিক অর্থেই বাড়াতে হবে; ৭। নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ল্যাবরেটরিগুলোয় রি-এজেন্ট কিট ও অন্যান্য মালামাল সরবরাহের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে; ৮। যেসব হাসপাতালে কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যসেবা চালু রয়েছে, সেখানেই রোগীদের পিসিআর পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে;

৯। বুথ স্থাপনের মাধ্যমে ব্র্যাক যেসব নমুনা সংগ্রহ করছে বা করবে সেগুলো পূর্ণ সমন্বয়ের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট ল্যাব থেকে ২৪ ঘণ্টার ভিত্তিতে ফলাফল জানানোর ব্যবস্থা নিতে হবে; ১০। সমন্বিত ডেটা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে হবে; ১১। নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য নরমাল স্যালাইনের পরিবর্তে ভাইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়া বা স্টোরেজ সলুশন ব্যবহার করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, যেসব ল্যাব একটি পিসিআর মেশিন, নতুন স্থাপন করা হয়েছে সেগুলোয় সক্ষমতা অনুযায়ী পরীক্ষা হচ্ছে না। কারণ, সেখানে প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব রয়েছে। পেশাদার প্রতিষ্ঠানগুলোয় দক্ষ জনবল থাকায় সেখানে পিসিআর মেশিনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/306637