ফাইল ছবি
৫ মে ২০২০, মঙ্গলবার, ২:০৮

করোনাকালে আজ বিশ্ব অ্যাজমা দিবস

শ্বাসকষ্টের রোগীরা বিপদে

মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে গতকাল সোমবার পর্যন্ত বিশ্বে ৩৬ লাখের মতো মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১৮২ জনের। অজানা এই ভাইরাসটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।

এমন কঠিন এক বাস্তবতার মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব অ্যাজমা দিবস। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য- 'অ্যাজমায় অনেক মৃত্যু'। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দিবসটির গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ অ্যাজমা রোগীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বহুগুণ বেশি। করোনায় অ্যাজমা রোগীদের মৃত্যুহারও বেশি। গ্লোবাল ইনেশিয়েটিভ ফর অ্যাজমা (জিনা) করোনা মহামারির কারণে অ্যাজমা দিবসের সব অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। সংগঠনটির ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তিতে অ্যাজমা রোগীদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের ইনহেলার ও ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশেও দিবসটি নিয়ে এবার কোনো আয়োজন নেই।

বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আলী হোসেন সমকালকে বলেন, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রীয় রোগে ভুগছেন- এমন ব্যক্তিদের করোনাভাইরাসে সংক্রমণজনিত জটিলতার ঝুঁকি অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশের শ্বাসতন্ত্রীয় সমস্যা ছিল। ভাইরাসটি শ্বাসক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্ট্রাকচার ও টিস্যুতে আক্রমণ করে। জটিলতার মধ্যে শুধু তীব্র নিউমোনিয়া নয়, অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিন্ড্রোমও (এআরডিএস) ডেভেলপ হতে পারে। এআরডিএসে ফুসফুসের টিস্যু পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। যেসব ফুসফুসীয় রোগ করোনা জটিলতার উচ্চ ঝুঁকি বহন করে, তা হলো অ্যাজমা ও ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)। সিওপিডির মধ্যে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস ও এল্ফিম্ফসেমা উভয়ই রয়েছে। সিওপিডির প্রধান কারণ হচ্ছে ধূমপান। তাই যারা বছরের পর বছর ধরে ধূমপান করে আসছেন, তাদের করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সৃষ্ট জটিলতার বাড়তি ঝুঁকি রয়েছে।

ডা. আলী হোসেন আরও বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে অ্যাজমা। এরই মধ্যে উপসর্গ প্রকাশ পায়নি এমন অ্যাজমা রোগীদের ফুসফুসের কার্যক্রমও কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্বাসতন্ত্রের যে কোনো সংক্রমণে অ্যাজমা রোগীদের ফুসফুসের বায়ু চলাচল নালিতে প্রদাহ হয়ে অ্যাজমা অ্যাটাক হতে পারে। সুতরাং অ্যাজমা রোগীদের কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। কারণ তার শ্বাসকষ্ট দেখা দেবে। তখন আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সাপোর্টের প্রয়োজন হবে।

ঝুঁকি কতটুকু : অ্যাজমা, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের রোগীরা করোনা আক্রান্ত হলে তাদের ঝুঁকি কতটুকু সে বিষয়ে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ইনচার্জ ডা. আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের পর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে মোট ৪২ জনকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছিল। অ্যাজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিন্ড্রোমও (এআরডিএস) থাকায় তাদের আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ১৬ জন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। বর্তমানে ১০ জন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে দু'জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। আটজনের অবস্থা স্থিতিশীল।

বয়স অনুযায়ী বিভাজন করলে দেখা যায়, মৃত ব্যক্তিদের ৪২ শতাংশ ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সের ২৭ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের ১৯ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৭ শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের ৩ শতাংশ এবং ১০ বছরের নিচে ২ শতাংশ।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার সমকালকে বলেন, আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। তবে তাদের মধ্যে কত শতাংশ অ্যাজমা, হাঁপানি, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন, সে সম্পর্কে পর্যালোচনা এখনও চলছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর ব্রঙ্কোলজি অ্যান্ড ইন্টারভেনশনাল পালমনোলজি (বিএবিআইপি) মহাসচিব ডা. সাইদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, অ্যাজমা রোগীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা হয়েছে। তাদের মৃত্যুঝুঁকিও অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। তাই যাদের অ্যাজমা আছে, তাদের করোনা হোক বা না হোক, সেলফ কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও বাসাবাড়িতে চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু অ্যাজমা রোগীরা করোনা আক্রান্ত হলে তাদের বাসাবাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সংক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব হাসপাতালে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সুবিধা আছে, সেখানে ভর্তি করতে হবে। যাতে করে মারাত্মক শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউতে নিয়ে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ অ্যাজমাজনিত রোগে ভুগছে। বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার মোট সাত শতাংশ, অর্থাৎ এক কোটি ১২ লাখ মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত। তবে দেশে অ্যাজমা রোগীর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশনের ২০১০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত বলে জানানো হয়। এর মধ্যে সাত দশমিক দুই শতাংশ শিশু। অ্যাজমা নিয়ে কাজ করে এমন আরেকটি সংগঠন অ্যাজমা অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ। এই সংগঠনের ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশে ৭০ লাখ মানুষ অ্যাজমা রোগে আক্রান্ত বলে জানানো হয়েছিল। এর পর অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বা এ রোগ নিয়ে আর কোনো পর্যবেক্ষণ হয়নি।

জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহিদুর রহমান সমকালকে জানান, গবেষণার জন্য যে পরিমাণ আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, তা তাদের নেই। এ কারণে দেশে কত মানুষ অ্যাজমায় আক্রান্ত, তা জানা সম্ভব হচ্ছে না।

রাজধানীর শ্যামলীতে ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ও উপ-পরিচালক ডা. আবু রায়হান সমকালকে বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় অ্যাজমা রোগী বেড়েছে। কারণ একবার কেউ অ্যাজমা আক্রান্ত হলে তাকে সারাজীবন তা বহন করতে হয়। নিয়মিত ওষুধ সেবন ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব নয়। প্রতিবছরই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

করোনায় আরও যাদের ঝুঁকি বেশি : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মৌসুমি ফ্লুর চেয়ে করোনাভাইরাস ১০ গুণ বেশি প্রাণঘাতী। বয়স্ক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন সমকালকে বলেন, অ্যাজমার মতো ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার ও কিডনি রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারিতে বয়স্কদের মৃত্যু এবং মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতার ঝুঁকির বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়েছে। একই সঙ্গে অ্যাজমা. হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা যাদের আছে, তারা করোনা আক্রান্ত হলে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এসব রোগে আক্রান্তরা কীভাবে সুরক্ষিত থাকবেন, সে সম্পর্কে একটি গাইডলাইন তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হচ্ছে। এসব বিষয় মেনে চললে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুরক্ষিত থাকবেন।

https://samakal.com/todays-print-edition/tp-first-page/article/200538130/