৪ মে ২০২০, সোমবার, ২:৩১

ফিরবে ১০ লাখ কর্মী

করোনায় তেলের দরপতনে মন্দায় সউদী আরব অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার ষ রেমিট্যান্স খাতে বিপর্যয়ের শঙ্কা

অর্থনৈতিক মন্দায় সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে ফেরার ঝুঁকিতে পড়েছেন। নিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে নাও, নইলে বিভিন্নভাবে তাদের সমস্যায় ফেলা হবে- বাংলাদেশের জন্য ঠিক এমন হুমকিই এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এ পরিস্থিতিতে কেবল সউদী আরব থেকেই বিতাড়িত হবেন প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী। সউদী আরবের রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস গত মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এমন তথ্য জানিয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারীর সঙ্কটকালে দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি ঘরবন্দি। এর মধ্যে প্রায় চার লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি অবৈধ। সউদী ইকামার ফি দ্বিগুণ বৃদ্ধিসহ নানা কারণে এসব বাংলাদেশি অবৈধ হয়েছে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারীতে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এতে সউদীসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অর্থনীতিতে ভাটার টান শুরু হয়েছে। অভিবাসী কর্মীদের কমিয়ে স্ব স্ব দেশের অর্থনীতির চাকাকে কোনো মতে টিকিয়ে রাখার চিন্তা-ভাবনা করছে এসব দেশগুলো। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, শুধু সউদী আরব নয়, কুয়েত, কাতার, ইরাক, বাহরাইনসহ উপসাগরীয় দেশগুলো অবৈধ কর্মীদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে। এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ থেকে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে। জনশক্তি রফতানির দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতও বাংলাদেশি অবৈধ কর্মীর পাশাপাশি আসামিদের ফেরত পাঠাতে চাইছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। বিশেষ করে সউদী থেকে কত কর্মী ফেরত আসবে তা ভাবতেও পারছি না। তিনি বলেন, সউদী সরকার বাংলাদেশিদের ফেরত আনার তাগিদ দিচ্ছে। কিন্তু আমরা তাদের বলেছি, এক সঙ্গে এত লোক আনতে পারব না। আমরা আমাদের কর্মীদের অবশ্যই নিয়ে আসব। তবে ধাপে ধাপে আনতে চাই। তিনি বলেন, তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় সউদীর অর্থনীতি কিছুটা কঠিন অবস্থায় রয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশগুলোতে আগামীতে আমাদের কর্মীর চাহিদা কমবে। এছাড়া ছোটখাটো অপরাধে জেলে থাকা প্রবাসীদের ক্ষমা করে জেল থেকে সোজা বিমানে তুলে দিচ্ছে।

বিএমইটির সূত্র জানায়, নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারির ১৫ দিনেই প্রবাসীরা প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে দেশে। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে দুই সপ্তাহে এত বেশি রেমিট্যান্স আসেনি। শুধু জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সউদী প্রবাসী কর্মীরা ৬২৯ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন।

১৯৭৬ সনে ২১৭ জন কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে সউদীতে বাংলাদেশি জনশক্তি রফতানি শুরু হয়। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটিতে ৪১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭২ জন নারী পুরুষ কর্মী চাকুরি নিয়ে গেছে। এছাড়া কুয়েতের চারটি অস্থায়ী ক্যাম্পে সাড়ে চার হাজার অবৈধ বাংলাদেশি কর্মী দেশটির সাধারণ ক্ষমার আওতায় দেশে ফেরার জন্য মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তারা গত পহেলা রমজান থেকে সাহরি ও ইফতারিতে প্রয়োজনীয় খাবার পাচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠছে। গত মাসের শেষের দিকে দু’টি ফ্লাইট যোগে ২৪৭ জন কর্মীকে কুয়েত থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দেশটিতে প্রায় ১৭ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে। এসব অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও ফেরত পাঠানো হবে।

বায়রার যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে লাখ লাখ প্রবাসী কর্মী ফেরত আসার আশঙ্কায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গতকাল রোববার ইনকিলাবকে বলেন, সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সউদী থেকে প্রচুর কর্মী ফেরত আসলে রেমিট্যান্স খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় আসবে। আগে থেকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ব্যাপক ক‚টনৈতিক উদ্যোগ নেয়ার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ভিশন-২০৩০-এর আওতায় দেশটিতে স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণ শুরু হলে প্রচুর বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সাল থেকে সউদী আরবের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের কারণে সেখানে থাকা বৈধ ও অবৈধ অন্য দেশের নাগরিকদের বিতাড়নের নীতি নিয়েছে দেশটির সরকার। এখন আর সাধারণ ক্ষমা করে পুনরায় বৈধ হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না সউদী আরব সরকার। এ প্রেক্ষাপটে সউদী আরবের রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস আশঙ্কা করছে, এবার ৫ থেকে ১০ লাখ বাংলাদেশিকে বিতাড়িত করবে সউদী সরকার। এ পরিস্থিতিতে গত বছরের শেষ দিক থেকে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস সউদীর ঘোষিত স্পেশাল এক্সিট প্রোগ্রাম (এসইপি) আওতায় পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ, হুরুব হয়ে যাওয়া, অবৈধ হয়ে যাওয়া অনিবন্ধিত বাংলাদেশি কর্মীদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সউদী আরব বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে। শুরুতে অবৈধ ও আনডকুমেন্টেড বাংলাদেশিদের নিয়ে আসতে বলছে। তারপর হয়তো বৈধভাবে যেসব বাংলাদেশি রয়েছেন, তাদের বিভিন্ন উপায়ে সউদীতে টেকা কঠিন করে দেবে দেশটি। এর উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষকে হয়তো এখনই ধরে বিতাড়িত করবে না সউদী সরকার। তবে আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বিশালসংখ্যক বাংলাদেশিকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করবে দেশটি। সম্প্রতি সউদী সরকার এক লাখ বাংলাদেশি কর্মীর ভিসা বাতিল করেছে। এতে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে। যদিও দেশটির সরকার এসব ভিসার জমাকৃত ফি ফেরত দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

সউদী থেকে একাধিক সূত্র জানায়, ভিশন-২০৩০ অনুযায়ী পুরো সউদীর শ্রমবাজারে ৭০ শতাংশ সউদী আরবের নাগরিককে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। এটি বাস্তবায়নে সব দেশের অভিবাসী কর্মীদের ক্রমান্বয়ে ছাঁটাই করে নিজ দেশে ফেরত পাঠাবে সউদী সরকার। এরই মধ্যে সউদী সরকার ইকামার ফি দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। বিভিন্ন দোকান-পাট শপিংমলে সউদী নারীদের চাকরি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যার কারণে এরই মধ্যে মিসরের ১১ লাখ নাগরিকসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা সউদী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আরো দেশের নাগরিকরা সউদী ছাড়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।

https://www.dailyinqilab.com/article/289023/