ছবি: সংগৃহীত
১ মে ২০২০, শুক্রবার, ৪:৪৮

শ্রমিকের চ্যালেঞ্জের বছর

দেশে বাড়বে বেকারত্ব, প্রবাসী ১ কোটি শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য অংশই চাকরি হারাবে -আশঙ্কা বিভিন্ন সংস্থার: ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বের ৩৩০ কোটি শ্রমিক

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাস ছিল ২০২০-২১ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংকট, ইউরোপে ব্রেক্সিটসহ নানা কারণে অর্থনীতির শ্লোথগতিতে এমন পূর্ভাবাস দিয়েছে সংস্থাগুলো।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চলমান করোনাভাইরাসের মহামারী। যা পুরো বিশ্বকে স্থবির করে দেয়। এটি মোকাবেলায় প্রস্তুতি ছিল না কোনো দেশেরই। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে শ্রমিকরা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনার আঘাতে বিশ্বে ৩৩০ কোটি শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের শ্রমঘন শিল্পে বেকারত্ব মারাত্মক আকার ধারণ করবে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে দেশে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ বেকার।

আর এই মুহূর্তে করোনা থেমে গেলেও নতুন করে বেকারত্বের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ২ কোটি মানুষ। শুধু দেশেই নয়, কাজ হারানো ঝুঁকিতে দেশের অর্থনীতির অন্যতম বৃহৎ শক্তি প্রবাসীরা। প্রবাসে থাকা ১ কোটি শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য অংশই বেকার হয়ে পড়বে- এমন আশঙ্কা বিভিন্ন সংস্থার।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। আর ‘লকডাউন’ দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। পরিস্থিতি মোকাবেলায় শ্রমিক সংগঠনগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। সব পক্ষই সরকারের কাছে প্রণোদনা চাচ্ছে।

জানা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশিই শ্রমিক। প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসছে। এই শ্রমিকের ওপর ভিত্তি করেই শক্তিশালী হচ্ছে অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির আকার বড় হলেও আয়ে বৈষম্যও ছিল ব্যাপক।

এ অবস্থায় করোনা-উত্তর দেশে বিনিয়োগে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে জনশক্তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অর্থনীতির যে হিসাব ছিল, করোনা সবকিছুই পাল্টে দিয়েছে। শ্রমিকদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। তার মতে, দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি হল বেশির ভাগ মানুষ কর্মক্ষম। এদের মজুরিও প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কম।

তবে সামগ্রিকভাবে বিচার করলে শ্রমিকদের দক্ষতার অভাব রয়েছে। জনশক্তি এখনও সম্পদে পরিণত হয়নি। ফলে শ্রমিকদের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগানো যায়নি। তিনি বলেন, দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে না। এ কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি। এ অবস্থার উত্তরণে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

পাশাপাশি বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে এই জনশক্তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বিষয়টি বিবেচনা করে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

শ্রম আইন ২০০৬ সালের ২(৬৫) ধারায় বলা হয়েছে, শ্রমিক হল ওই ব্যক্তি, যিনি তার চাকরির শর্ত পালন করে কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোনো ঠিকাদারের মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানিগিরির কাজে নিযুক্ত।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ২৮ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে সেবা খাতের অবদান ৫৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ, শিল্পের ৩১ দশমিক ১৫ এবং কৃষি খাতের ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। আবার জিডিপির সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ (রেমিট্যান্স) যোগ করলে হয় জাতীয় আয়। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে পড়ে। অর্থনীতির এই অর্জনের পেছনে শ্রমিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। দেশের শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে নতুন কর্মশক্তি। তৈরি পোশাক, কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে প্রতিদিনই নতুন শ্রমশক্তি আসছে। এরাই তাদের মেধা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব : সম্প্রতি করোনার কারণে বেকারত্ব সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে আইএলও। এতে বলা হয়, করোনায় বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে স্থবিরতা নেমে এসেছে, তাতে ৩৩০ কোটি কর্মক্ষম মানুষের আংশিক বা পুরোপুরি বেকার হতে পারে।

শতকরা হিসাবে যা ৮১ শতাংশ। সারা বিশ্বে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা চারশ’ কোটির বেশি। এছাড়া ১৬০ কোটি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক ইতোমধ্যে বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে এসেছে।

জাতিসংঘের এই সংস্থা বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন সংকট আর দেখা দেয়নি। তবে বছরের শেষ ৬ মাসে অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়ালে এবং কার্যকর নীতিকৌশল অবলম্বন করা গেলে পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব।

সংস্থাটির মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেছেন, উন্নত ও উন্নয়নশীল- দুই ধরনের দেশেই এ সংকট দেখা দিয়েছে। ২০২০ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি ৫০ লাখ পূর্ণকালীন কর্মজীবী মানুষের চাকরি হারাবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির হিসাবে প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসছে। কিন্তু গত দুই বছরে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে ১২ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ নতুন শ্রমিকদের বড় অংশই বেকার থেকে যাচ্ছে। আইএলও’র স্বীকৃত পদ্ধতি অনুযায়ী, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করেন এমন ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয়।

এ হিসেবে বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, সপ্তাহে ১৫ ঘণ্টার কম কাজ করেন, বাংলাদেশে এমন শ্রমিক রয়েছেন ৫৫ লাখ। আর ১৫ ঘণ্টা কাজ করেন ব্যক্তির সংখ্যা ৮১ লাখ।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি। এদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। এদের ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট’ বা জনসংখ্যার বোনাস বলে। ২০৩০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ১২ কোটি ৯৮ লাখে উন্নীত হবে। আবার মোট শ্রমশক্তির অর্ধেকের বেশি হল তরুণ প্রজন্ম। যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর।

আর বিভিন্ন ধরনের কাজ করে উপার্জন করেন দুই কোটি ১৫ লাখ তরুণ-তরুণী। অর্থাৎ এরা কর্মক্ষেত্রের যুবশক্তি। অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) ক্ষেত্র হিসেবে দোকানপাট, ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষি কাজ ইত্যাদিকে বিবিএস চিহ্নিত করেছে। আর আনুষ্ঠানিক (ফরমাল) ক্ষেত্র হল- সরকারি অফিস-আদালত, বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সেবা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

জানতে চাইলে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, আমরা জনশক্তির বোনাস পেয়েছি। এটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু মূল কথা হল জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান দরকার।

তিনি বলেন, জনশক্তিকে আবার দক্ষ করে তুলতে হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ দেশের বাইরে কাজ করে। বছরে এরা ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠায়। আর বিভিন্ন দেশের ২ লাখ লোক বাংলাদেশে কাজ করে। তারা ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স নিয়ে যায়। অর্থাৎ দেশের শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।

প্রাপ্ত্য তথ্য অনুসারে দেশে মোট জনশক্তি ১৬ কোটি ৫৬ লাখ। আর বিভিন্ন খাতে শ্রমিক ৯ কোটি ৬২ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৭ কোটি ১২ লাখ এবং নারী ২ কোটি ৫০ লাখ। বিবিএসের জরিপ অনুসারে পেশার দিক থেকে কর্মক্ষেত্রে কৃষক, মৎস্যজীবীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে দেশে দুই কোটি ৭৪ লাখ কৃষক ও মৎস্যজীবী এই পেশায় নিয়োজিত। এরপরই রয়েছে উৎপাদন ও পরিবহন শ্রমিক। এই খাতের শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ। আর সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এক কোটি ৩৭ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। তবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে এর সংখ্যা আট লাখ ৮৭ হাজার।

এছাড়া স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কাজ করেন তিন লাখ ৬৮ হাজার লোক। ৩২ লাখ ৮৪ হাজার লোক নিয়োজিত আছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। আর বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করছেন ছয় লাখ ৮৮ হাজার লোক। গেরস্তালিতে কাজ করেন এক কোটি ১৮ লাখ নারী-পুরুষ।

প্রণোদনা দাবি : করোনা মোকাবেলায় এ পর্যন্ত ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। তবে তার বেশির ভাগ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ঋণ আকারে দেয়া হবে। শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও প্রণোদনার দাবি আসছে।

কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঢালাওভাবে সব খাতের জন্য প্রণোদনা দেয়া সম্ভব নয়। কারণ এমনিতেই কর আদায় না হওয়ায় সরকারের আয় কমছে। এরপর সবগুলো শ্রম খাতে প্রণোদনা দেয়ার মতো সক্ষমতা সরকারের নেই।

পিছিয়ে পড়বে এসডিজি অর্জন : আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মূল কথা হল, পৃথিবীর সব মানুষের উন্নত জীবনযাপনের আকাক্সক্ষা। এ কারণে এর স্লোগান হল, একজনও পিছিয়ে থাকবে না।

এসডিজির মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রথমটি হল দরিদ্রতা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে আসা। এরপরই রয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং টেকসই কৃষি। তৃতীয় : সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা। চতুর্থ : শিক্ষা। পঞ্চম : লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। ষষ্ঠ : পানি ও স্যানিটেশন। সপ্তম : জ্বালানি নিশ্চিত করা।

অষ্টম : রেকারত্ব দূর করে অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত। নবম : অবকাঠামো উন্নয়ন করে শিল্পায়ন এবং উদ্ভাবন। দশম : বৈষম্য দূর করা। এর মানে হল, লক্ষ্যমাত্রাগুলোর প্রায় সবগুলো অর্থনৈতিক। আর করোনার কারণে মানুষ বেকার হলে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন পিছিয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/303216/