২৬ এপ্রিল ২০২০, রবিবার, ৪:৫৪

আলোচিত জানাজা: নো প্রবলেম স্যার, আমি ঘটনাস্থলেই আছি...

বাস্তবে বাসায় ছিলেন ওসি

‘নো প্রবলেম স্যার, আমি ঘটনাস্থলেই আছি। সবকিছু আন্ডার কন্ট্রোল।’ পুলিশ সুপারের ফোন পেয়ে এ কথা বলেন সরাইল থানার ওসি। অথচ বাস্তবে এ সময় তিনি ছিলেন নিজের বাসায়। জানাজা অভিমুখী মানুষের ঢল দেখে ওসিকে ফোন করেন পুলিশ সুপার।

কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিজে মাঠে না গিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে মিথ্যা তথ্য দেন তিনি। এমনকি জনস্রোত দেখে জেলার অন্য কর্মকর্তারা ওসিকে একাধিকবার ফোন করেন। বেতার বার্তাও দেয়া হয়। কিন্তু তিনি কারও ফোন ধরেননি। বেতার বার্তার কোনো উত্তরও দেননি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া আনসারী হুজুরের জানাজা-কাণ্ডের তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনসমাগম ঠেকাতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা গাফিলতি ও চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন।

মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের কাজে কোনো সমন্বয় ছিল না। জনস্রোত ঠেকাতে পার্শ্ববর্তী আশুগঞ্জ ও বিজয়নগর থানা পুলিশও যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি।

চলমান করোনা দুর্যোগের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ১৮ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলায় খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা যুবায়ের আহমেদ আনসারী হুজুরের জানাজায় লাখো মানুষের জমায়েত হয়। যা আগে থেকে সামাল দিতে স্থানীয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়।

ঘটনার জেরে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঘটনার দায়-দায়িত্ব নিরূপণে পুলিশের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। চলতি সপ্তাহেই এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা হতে পারে। ২৩ এপ্রিল প্রতিবেদন জমার নির্ধারিত তারিখ ছিল।

তদন্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ইকবাল হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াটি পুলিশ সদর দফতর থেকে মনিটর করা হচ্ছে।

বুঝতেই পারছেন, অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমরা তদন্ত কাজটি চালিয়ে যাচ্ছি। সরাইল থানার ওসি বাসায় বসে ঘটনাস্থলে থাকার অভিযোগটি প্রমাণের জন্য সিডিআরসহ আরও কিছু প্রযুক্তিগত তথ্য-উপাত্ত একসঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

কমিটির আরেক সদস্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিকভাবে ৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে জনস্বার্থে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন অধিকতর তদন্তে আরও যাদের দায়িত্বে অবহেলা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাসায় বসে ঘটনাস্থলে থাকার মিথ্যা তথ্য দেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরাইল থানার সদ্য সাবেক ওসি শাহদাত হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, যেহেতু বিষয়টি উচ্চপর্যায় থেকে তদন্ত করা হচ্ছে, তাই এ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য দেয়া বা মন্তব্য করা উচিত হবে না।

তবে আমার দায়-দায়িত্বের কতটুকু গাফিলতি ছিল তা কমিটির সামনে আমি ইতোমধ্যে বলেছি। তবে শাস্তিমূলক প্রত্যাহার হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে লক্ষ্মীপুর জেলায় নতুন করে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। ফলে তার বিরুদ্ধে গৃহীত বিভাগীয় ব্যবস্থা আসলে কতটা শাস্তিমূলক, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রযুক্তির সহায়তায় ওসি শাহদাত হোসেনের অবস্থান নির্ণয় করে দেখা যায়, তিনি বাসায় বসে এসপির ফোন ধরে বলেন ঘটনাস্থলে আছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সুপার ছাড়া জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তাও তাকে বারবার ফোন করেন। কিন্তু তিনি আর কারও ফোন রিসিভ করেননি।

সূত্র বলছে, সরাইল থানা পুলিশ ছাড়াও আশুগঞ্জ ও বিজয়নগর থানা পুলিশও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ছিল না। তারা সক্রিয় হলে শুরুতেই জনসমাগম ঠেকিয়ে দেয়া যেত। কারণ, জানাজাস্থলে আসতে হয় আশুগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু পার হয়ে। সেতুর টোল প্লাজার কাছাকাছি পুলিশের টহল চেকপোস্টও রয়েছে। কিন্তু হাজার হাজার লোক ঢুকতে থাকলেও কাউকে বাধা দেয়নি পুলিশ।

তবে দায়িত্বহীনতার অভিযোগ মানতে রাজি নন সংশ্লিষ্ট দুই থানার ওসি। আশুগঞ্জ থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ বলছেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আশুগঞ্জ টোল প্লাজার নিরাপত্তা চৌকি থেকে জানা যায় আগতদের বাধা দেয়া হয়। পুলিশের বাধা পেয়ে অনেকেই ফিরে যেতে বাধ্য হন।

বিজয়নগর থানার ওসি আতিকুর রহমানের দাবি, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সাত বর্গ এলাকায় পুলিশের নিরাপত্তা চৌকি থাকার কারণে জানাজাস্থলে কেউ ঢুকতেই পারেনি। ঘটনার দিন ভোর সাড়ে ৬টার দিকে ৭-৮টি ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস টোল প্লাজায় আসার পর পুলিশ বাধা দেয়। আগতরা তখন ক্ষেপে যায়। বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান।

যুগান্তরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি শফিকুল ইসলাম বলেন, শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় মানুষ নয়, আশপাশের জেলা থেকেও বহু লোক জানাজায় অংশ নেয়। তবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের দাবি জেলা লকডাউন থাকায় যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। ফলে অন্য জেলা থেকে লোক আসার কথা সত্য নয়।

এ অবস্থায় প্রকৃত তথ্যের খোঁজে টোল প্লাজার সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করেছে তদন্ত কমিটি। ঘটনার আগে পরে কোন কোন গাড়ি টোল প্লাজা দিয়ে ঢুকেছে তার নম্বর এবং সংশ্লিষ্ট চালকের নম্বর সংগ্রহ করেছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া সংক্রমণ রোধে আশুগঞ্জ ও সরাইল এলাকার ৭টি গ্রাম লকডাউন করেছে পুলিশ। এসব এলাকায় সার্বক্ষণিক তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/301650/