২১ এপ্রিল ২০২০, মঙ্গলবার, ৬:২২

করোনার মধ্যেই ডেঙ্গুর হানা

মশা না মারলে দুরাবস্থায় পড়তে হবে : প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম

ডেঙ্গু নিধন কার্যক্রম অব্যাহত আছে : ডিএসসিসি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা

করোনায় থমকে গেছে বিশ্ব, পুরো বাংলাদেশ করোনার ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে এরই মধ্যে হানা দিয়েছে মশাবাহিত আরেক আতঙ্ক ডেঙ্গু। গত বছর দেশে রেকর্ড সংখ্যক এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এ বছরের শুরু থেকেই সেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আবারও দেখা দিয়েছেএ যদিও এর ভয়াবহতা এখনও সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। তবে ইতিমধ্যে ডেঙ্গুর মৌসুম এপ্রিল মাস শেষ হতে চলেছে। তাই রাজধানীবাসী আতঙ্কে আছে কখন এই দুরবস্থার মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ হাসপাতালগুলোতে মিলছে না কোন ধরনেরই চিকিৎসা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋতু বদলজনিত কারণে এখন যেহেতু মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া বদলাচ্ছে। তাই শুষ্ক স্থানে আগে থেকে পেড়ে রাখা এডিস মশার ডিম থেকে লার্ভা তৈরি হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হচ্ছে প্রকৃতিতে। করোনার ডামাডোলের ভেতরেই এখন থেকেই এডিসসহ সব ধরনের মশা নিধন কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এডিস ছাড়াও কিউলেক্স মশার ঘনত্ব গত ডিসেম্বর মাস থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশে ভয়াবহভাবে বেড়েছে। গত বছর মশা নিধনে প্রথমে রাজধানী ও পরে দেশজুড়ে ওষুধ প্রয়োগ করা হলেও এ বছর এখনও পর্যন্ত সে কার্যক্রম শুরুই হয়নি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গু নিধন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তবে করোনার জন্য আমরা সবাই আতঙ্কিত। এক্ষেত্রে কাজে কিছুটা হলেও বিঘœতার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে নিজস্ব কর্মীরা আছেন, তারা কাজ করছেন। শরীফ আহমেদ বলেন, প্রতিদিন সকালে লার্ভিসাইড স্প্রে করা হয়। দুপুরে জীবাণুনাশক ছিটানো হয়। বিকালে এডাল্টি সাইড বা ফগার মেশিন দিয়ে স্প্রে করে মশা নিধন করা হচ্ছে।

ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আসতে শুরু করেছে হাসপাতালগুলোতে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ কন্ট্রোল ইমার্জেন্সি ও অপারেশন্স সেন্টার থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৯০ জন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ২৮৮ জন। ভর্তি আছেন ২ জন। তবে এখন পর্যন্ত কোনও মৃত্যু নেই। যদিও কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি)-এর উলিপুর উপজেলার দায়িত্বরত উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. জুবাইদুল ইসলাম গত ৮ এপ্রিল সেখানেই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন। তবে হার্টের সমস্যা ও শ্বাসকষ্ট থাকায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে ঢাকায় আনার পথে তার মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে গত বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। মারা গেছেন ২৬৬ জন। গত বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এবার এখনই ব্যবস্থা না নিলে গত বছরের চেয়েও পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে ডেঙ্গু রোগী বাসা থেকে বের হচ্ছে না। তারপরও রোগী ধীরে ধীরে বাড়ছে। তাই এখনই মশা নিধণ কার্যক্রম হাতে নিতে হবে ঢাকাসহ দেশজুড়ে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের জন্য রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকার প্রধান সড়কগুলো জীবাণুনাশক দিয়ে ভেজানো হলেও এই পানি ফুটপাথে বা পথের দু’পাশে পড়ছে না। আর ডেঙ্গু মশা যেহেতু পরিষ্কার পানিতে ডিম ফোটায়, ফলে করোনাভাইরাসের কারণে শহরের যেসব এলাকায় নির্মাণকাজ অসমাপ্ত রেখে শ্রমিকরা চলে গেছেন, সেসব জায়গায় ঝড়-বৃষ্টির পরের অবস্থা কী তা জানতে সিটি কর্পোরেশনগুলোর এখনই ভূমিকা নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি ডেঙ্গু মশা ডিম পাড়তে পারে বা বংশবিস্তার ঘটাতে পারে এমন জায়গাগুলো পরিচ্ছন্ন করার এই মুহূর্তে ভীষণ দরকার হয়ে পড়েছে।

গবেষক আতিক আহসান বলেছেন, আবহাওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সপ্তাহে বেশ কয়েকবার বৃষ্টি হতে পারে। প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এই বৃষ্টির কারণে আগামী মাসের শুরু থেকেই আবার এডিস মশা বাড়তে শুরু করবে। আর এই মশা বাড়াবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। কারণ, বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর থেকে গড়ে ১০ দিন সময় দরকার হয় ডিম থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হতে। সে হিসেবে মে মাসের শুরু থেকেই এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করবে। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে আতিক আহসান বলেন, সে কারণে এখন থেকেই ডেঙ্গু নিয়ে ভাবার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। ডেঙ্গু এবং এডিস মশা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও কীটতত্ত¡বিদ কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এখনো বর্ষা মৌসুম শুরু হয়নি। আমরা আশঙ্কা করছি এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে এবার বর্ষার মৌসুমে জুন-জুলাই মাসে গতবারের চেয়ে ডেঙ্গু রোগী অনেক বেশি হবে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। তিনি বলেন, মার্চ, এপ্রিল এবং মে এই তিন মাস এডিস মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করার ওপর জোর দেয়া দরকার। এরপর থেকে বিভিন্ন রাসায়নিকের মাধ্যমে এডিস মশা ধ্বংস করতে হবে। মার্চ মাসে যদিও করা হয়নি। তাই এখনই সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে সক্রিয় হতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আফসানা আলমগীর খান বলেন, যেহেতু ডেঙ্গু এবং করোনার লক্ষণ-উপসর্গ এক, অর্থাৎ জ্বর নিয়েই রোগীরা আসছেন, কিন্তু করোনার ডায়াগনোসিসে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করা হচ্ছে না। তাই একে মাথায় রেখে দেশের সব সিভিল সার্জন অফিসে চিঠি দেওয়া হয়েছে, জ্বরের রোগী এলে যদি কোভিড-১৯ নেগেটিভ হয় তাহলে ডেঙ্গু অথবা যেকোনও জ্বরের যেসব পরীক্ষা আছে তা যেন করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, ডেঙ্গু ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে দ্রæত ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ছাড়া কোন উপায় নেই। মশা মারতে না পারলে আমাদের দুরবস্থায় পড়তে হবে। তিনি বলেন, করোনার কারণে সবাই লকডাউনে আছি। তাই ব্যক্তিগত সচেতনতাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। সিটি কর্পোরেশন উদ্যোগ নিবে না। চিকিৎসা পাওয়ারও সুযোগ নেই। তাই এখন কপালে যা আছে তার দিকে চেয়ে থাকতে হবে উল্লেখ করেন তিনি।

https://www.dailyinqilab.com/article/285218