২০ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ৬:০৬

অনাহারে যেন কোনো মানুষের মৃত্যু না হয়

একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

নিঃসন্দেহে দেশ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে বর্তমান ও করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে। পরবর্তী অভিঘাত তো নিঃসন্দেহে গুরুতর হবে। রফতানি খাত, নির্মাণ খাত, রেমিট্যান্সপ্রবাহ, যোগাযোগব্যবস্থা, কর্মসংস্থানসহ বেশির ভাগ খাতে নেতিবাচক প্রভাবের মাত্রা বাড়বে। কাজেই সব মিলিয়েই অর্থনীতিতে বড় মাত্রার আঘাত পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বেকারত্ব তো অবশ্যই বাড়বে। সে জন্য সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বাড়াতে হবে। সুবিধাভোগীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ভিজিডি, ভিজিএফ, ওএমএস ইত্যাদির পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে। মোট কথা হলো আমি মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি কী হলো না হলো, সেটা বড় বিষয় নয়। আমাদের নজর রাখতে হবে অনাহারে যেন কোনো মানুষের মৃত্যু না হয়।
নিচে তার সাক্ষাৎকারটির বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।

নয়া দিগন্ত: করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে অভিঘাত কতটা গুরুতর হবে বলে মনে করেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অভিঘাত তো নিঃসন্দেহে গুরুতর হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক তারা তো বলেছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। ২ না ৩, ৪ না ৫ হবে তা আমার পক্ষে বলাটা মুশকিল। তবে নিঃসন্দেহে প্রবৃদ্ধি আরো কমে যাবে। আমরা যদি খাতগুলোর কথা বিবেচনা করি তাহলে আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে রফতানি আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। রফতানি প্রবৃদ্ধি করোনাভাইরাস আক্রমণের আগে থেকেই কমতে শুরু করেছিল। নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে চলে এসেছিল। করোনার প্রভাবের ফলে এই নেতিবাচকের মাত্রা আরো বাড়বে। বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা কমবে। ইতোমধ্যে অনেক দেশ পণ্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত রাখতে বা বাতিল করতে বলেছে। তৈরী পোশাক শিল্পের ৮৬ শতাংশ তন্তু আসে চীন থেকে। চীনের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। এ ছাড়া ভারত থেকেও অনেক কাঁচামাল আসে। সেখানেও লকডাউন চলছে। শিল্পের কাঁচামাল না এলে উৎপাদন কম হবে। এ ছাড়া সরবরাহের সমস্যা তো আছেই।

আবার রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল। সেখানেও ধস নামবে। কারণ আমাদের প্রবাসীরা যেসব দেশে কাজ করেন তার সবগুলো দেশই বড় মাত্রায় আক্রান্ত। তারা সেখানে থাকলেও কাজ হারিয়েছেন, বেতন পাচ্ছেন না। আর যারা দেশে ফিরে এসেছেন তারাও যেতে পারবেন না। নতুন কোনো লোকও নিয়োগ হবে না। আবার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিবহন তো নেই বললেই চলে। নির্মাণ খাতেও ধস। কারণ লোকজন বাড়ির বাইরে যেতে পারছে না। বিভিন্ন জায়গায় যে পণ্য পরিবহন সেটাও হচ্ছে না। পরিবহন ও নির্মাণ খাতে বড় মাত্রায় অভিঘাত আসবে। ইতোমধ্যেই এসেছে। কাজেই সব মিলিয়েই অর্থনীতিতে বড় মাত্রার আঘাত পড়বে।

নয়া দিগন্ত: সঙ্কটের কারণে প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশীরা ফেরত আসছে এবং সামনেও আসবে। এতে আমাদের বেকারত্ব তো বাড়বে। এটা সামাল দিতে আপনার পরামর্শ কী?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: যেসব দেশে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা আছে, সে দেশও তো তাদেরকে রাখতে চাচ্ছে না। তারা চাচ্ছে বাংলাদেশ তাদেরকে নিয়ে আসুক। আর যেহেতু তারা আমাদের দেশের নাগরিক তাই তাদেরকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব তো আমাদের। আমাদের যা করতে হবে তা হলো, তারা ফেরত আসার পরে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে। যাতে তাদের মাধ্যমে নতুন করে কোনো সংক্রমণ না হয়।

সামনে বেকারত্ব তো অবশ্যই বাড়বে। সে জন্য সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বাড়াতে হবে। সুবিধাভোগীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এখন সরকার তো বেশ কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। ভিজিডি, ভিজিএফ, ওএমএস ইত্যাদি আরো বাড়াতে হবে। মোট কথা হলো আমি মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি কী হলো না হলো, সেটা বড় বিষয় নয়। আমাদের নজর রাখতে হবে অনাহারে যেন কোনো মানুষের মৃত্যু না হয়। সে জন্য আমাদেরকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে পদক্ষেপ নিতে হবে।

করোনা-সঙ্কটের কারণে সরকারের আয় কমবে, ব্যয় বাড়বে। গরিব-নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সহায়তা বাড়াতে হবে। সরকারকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে করের হার কমাতে হবে। আবার কোনো ক্ষেত্রে মওকুফ করতে হবে।

নয়া দিগন্ত: করোনা-পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কী কী মনে করছেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: করোনা-পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে রফতানি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা। দ্বিতীয়ত: প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আসবে। তা থেকে উত্তরণ ঘটানো। প্রবাসী আয়ে আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ২১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা খুবই আশাব্যঞ্জক। জানুয়ারি মাসে কমে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। করোনা-সঙ্কটের কারণে প্রবাসী আয় আরো অনেক কমে যাবে। প্রবাসীদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বড় ধরনের কূটনৈতিক পদক্ষেপের দরকার হবে। সার্বিকভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ লাইন পুনরুদ্ধার করা হবে একটি চ্যালেঞ্জ। সেটা অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহারের পণ্যের জন্যেই হোক বা রফতানি পণ্যের জন্যেই হোক। এখন তো সরবরাহ লাইন বা সাপ্লাই চেইনগুলো ভেঙে পড়েছে। আমাদের অবকাঠামো খাতের যেসব প্রকল্প আছে সেগুলো তো করোনার কারণে বিলম্বিত হচ্ছে। সেগুলোকে আবার গতিশীল করতে হবে। যাতে করে বিভিন্ন অবকাঠামো খাতের প্রকল্প সময় মতো বাস্তবায়ন হয়। এ ছাড়া পুরনো যেসব চ্যালেঞ্জ আছে তার মধ্যে, সুশাসন নিশ্চিত করা, ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা, রেগুলেটরি রিফর্মস করা ইত্যাদি।

এ ছাড়া, যোগাযোগব্যবস্থা এখন অচল হয়ে পড়েছে। বৈদেশিক যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। বিমানের আয় কমে যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকরা চাকরি হারাবেন। তৈরী পোশাক খাতের কারখানাগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রমিকরা চাকরি হারাবেন। আর কর্মসংস্থান না হলে বেকারত্ব আরও বাড়বে। পাশাপাশি নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জীবনমানের অবনতি হবে।

নয়া দিগন্ত: নতুন অর্থবছরের বাজেট আসছে। এই বাজেট তৈরিতে সরকারকে কী কী পদক্ষেপ ও দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রাখতে হবে বলে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে আপনি মনে করেন?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: দুটো পরামর্শ থাকবে আমার। প্রথমত: আমাদের বাজেটের ঘাটতির মাত্রা নিয়ে এখন ভাবার দরকার নেই। এটা সাধারণত জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়, যদিও চূড়ান্ত হিসাবে এটা তার চেয়েও কম হয়। এখন ঘাটতির মাত্রা নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করার কোনো দরকার নেই। প্রয়োজন হলে ঘাটতির মাত্রা বাড়–ক। কোনো মানুষ যাতে অনাহারে না মারা যায় সে দিকটাতেই এখন লক্ষ রাখতে হবে। সে জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বরাদ্দ আগের তুলনায় বেশি বাড়াতে হবে। অবশ্য ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে, এটা জিডিপির ৩.৫ শতাংশ হবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী এটা হয়তো আরো বাড়ানোর দরকার হতে পারে।

দ্বিতীয়ত: প্রশ্ন আসবে বাজেটে যে ঘাটতি বাড়বে, এই ঘাটতি অর্থায়ন কোথা থেকে হবে? রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি তো আগেই খারাপ ছিল এটা বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সঞ্চয়পত্রে আগেই ধস নেমেছে, এটাও বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অনেক ব্যাংকেই তারল্য সঙ্কট আছে। কাজেই ব্যাংকগুলো থেকে ইতোমধ্যে যে ঋণ নিয়েছে তা পুরো বছরের বাজেটে যে প্রভিশন ছিল তার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। ফলে সেই সূত্রটাও ব্যবহার করতে পারবে না। তাই ঘাটতি অর্থায়নে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। বৈদেশিক সাহায্য অনুদান বা রেয়াতি ঋণ আকারে সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) আমাদের অপ্রয়োজনীয় না হলেও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্যতা নেই এমন অনেক প্রকল্প আছে। এখানে কাটছাঁট করতে হবে। সেখান থেকে কিছু টাকা আসবে। প্রাধিকারপ্রাপ্ত যেসব প্রকল্প আছে সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে।

নয়া দিগন্ত: সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের বরাদ্দ সঠিকভাবে মানুষ পাবে কি না তা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কলেবর বেড়েছে। সমস্যা তো আছেই। আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধা বিতরণের ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়ম তো আগে থেকেই আছে। আশা ছিল এমন দুর্দিনে মানুষের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা কম হবে। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। এখন প্রয়োজন শক্ত হাতে মনিটরিং করা। আর যাদেরকে অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত পাওয়া যাবে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া।

নয়া দিগন্ত: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনারাও ভালো থাকবেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/496838/