১৩ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ৫:০৬

লকডাউনে সড়ক অবরোধ

গাজীপুর-নারায়ণগঞ্জ-সাভারে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভ

বেতনের দাবি এবং ছাটাইয়ের প্রতিবাদে লকডাউন ভেঙে রাজপথে বিক্ষোভ করেছে গার্মেন্টস শ্রমিকরা। গতকাল গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার সাভারে শ্রমিকরা রাস্তা অররোধ করে বিক্ষোভ করে। শ্রমিকরা জানান, বাসা ভাড়া, দোকানে বাকি, ঘরেও খাবার শেষ হওয়ায় তারা অনাহারে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হেমায়েতপুর-সিংগাইর সড়কে গাছের ডাল ও কাঠের টুকরো ফেলে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করে। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জেও আইনশৃংখলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। মালিক পক্ষ বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ছাটাইয়ের সিদ্ধান্ত বাতিল করায় শ্রমিকরা চলে যায়।

গাজীপুর : গাজীপুরে লকডাউনের নিয়ম ভেঙে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। গতকাল সকালে গাজীপুর মহানগরীর সাইনবোর্ড ও ভোগড়া বাইপাস এলাকার ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপ ও নিউওয়ে ফ্যাশনস লিমিটেড পোশাক কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। শ্রমিকরা জানান, তারা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তিন মাসের বেতন না পেয়ে মহাসড়ক অবরোধ করতে বাধ্য হন।

নিউওয়ে ফ্যাশন লিমিটেডের নিটিং অপারেটর শাহিনা বেগম বলেন, আমরা দুই মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। কারখানা মালিক দেই-দিচ্ছি করে ঘুরাচ্ছে। এখন আমাদের ঘরে খাবার নেই। বাড়ি ভাড়া ও দোকানে বাকি পড়ে আছে। পাওনাদারদের জন্য বাসা থেকে বের হতে পারছি না। এর মধ্যে গাজীপুর লকডাউন করা হয়েছে। এখন আমাদের না খেয়ে মরার উপক্রম হয়েছে। সরকার যে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে তা কেবল যারা স্থানীয় ও গাজীপুরের যারা ভোটার তারা পাচ্ছেন। অন্যরা কোনো ত্রাণ পাচ্ছেন না। লকডাউনের নিয়ম ভেঙে শ্রমিকরা মহাসড়কে নেমে এলে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। টানা এক ঘণ্টা ঢাকা টু ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখার পর মালিকপক্ষ ১৬ এপ্রিল বেতন পরিশোধের ঘোষণা দিলে শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ তুলে নেন। পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। গাছা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইসমাইল হোসেন জানান, দুই মাসের বকেয়া বেতন দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা মহাসড়কে নেমে বিক্ষোভ করেন। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আগামী ১৬ এপ্রিল বেতন দেয়ার আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহার করেন।

সাভার : ঢাকার সাভারে বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় মার্স ডিজাইন লিমিটেড, ওয়ান ওয়াল্ড ডেনিম ওয়াশিং লিমিটেড, পাইওনিয়ার গামের্ন্টস লিমিটেড, গোল্ডেন স্ট্রিচ লিমিটেড, ত্বো-হা টেক্সটাইল, আদিত্ত এ্যাপারেলস, রাকিব এ্যাপারেলস, সুরাইয়া ফ্যাশন ও খান মেনসন কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। সরকারের ঘোষণার পর থেকেই কারখানাগুলো বন্ধ রয়েছে।

এর মধ্যে চার মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে হেমায়েতপুর এলাকার রাকিব এ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার বিক্ষুব্ধ শতাধিক শ্রমিকরা হেমায়েতপুর-সিংগাইর সড়কে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

গামের্ন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাভার-আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু জানান, বকেয়া বেতন-ভাতার জন্য সাভার আশুলিয়ায় ৯টি পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে। তবে তাদের বকেয়া পাওনাদির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

আশুলিয়ার কবিরপুর এলাকার ত্বো-হা টেক্সটাইল কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া এক মাসের (মার্চ) বেতন-ভাতার দাবিতে কারখানার প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হয়। পরে সেখানেই বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে তারা নবীনগর-চন্দ্রা সড়ক অবরোধ করে রাখে। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রাকিব এ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার একাধিক শ্রমিক জানায়, মালিক গত জানুয়ারি মাস থেকে শ্রমিকদের বেতন প্রদান নিয়ে টালবাহানা করে আসছিল। মার্চ মাসের বকেয়া বেতন পাঁচ তারিখে পরিশোধের কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ ওই দিন বেতন না দিয়ে ১৩ তারিখে বেতন পরিশোধের আশ্বাস দিয়ে কারখানাটি ছুটি ঘোষণা করেন।

সকালে শ্রমিকদের বেতন দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কারখানার একাধিক শ্রমিক অফিস স্টাফদের সাথে যোগাযোগ করে আজও বেতন দেয়া হবে না বলে জানতে পারে। পরে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে হেমায়েতপুর-সিংগাইর সড়কের ওপর জড়ো হয়ে গাছের ডাল ও কাঠের টুকরো ফেলে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর এসপি সানা সামিনুর রহমান বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ : জেলার সদর উপজেলার সস্তাপুর এলাকায় এ্যাবলুম নিট ডিজাইন লিমিটেড বেতন পরিশোধ না করে বন্ধ ঘোষণা করায় বিক্ষোভ করেছে কারখানার শ্রমিকরা। সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কারখানার সামনে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। শ্রমিকরা জানান, গত ২৪ মার্চ প্রথমবার কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ৫ এপ্রিল আবারও চালু হওয়ার পর দুপুরে বন্ধ করে দেয়া হয়। সে সময় ১২ এপ্রিল বেতন পরিশোধ করা হবে, জানায় কারখানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বেতন না দেয়ায় মার্চ মাসের বেতনের জন্য ৩ শতাধিক শ্রমিক কারখানার সামনে জড়ো হন। এ সময় কারখানার দরজায় ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত কারাখানা বন্ধ নোটিশ দেখতে পান তারা। বেতন দেয়া হবে কি না সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। শ্রমিকরা জানান, বাসা ভাড়া, দোকানে বাকি, ঘরেও খাবার শেষ। না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। বেতন না পেলে অনাহারে মরতে হবে।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি এম এ শাহীন বলেন, মালিকপক্ষের কারো সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। সরকার আগামী ১৬ এপ্রিলের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছে। তাই তাদের ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে। যদি এর মধ্যে বেতন না দেয় তাহলে আলোচনা করে সমস্যা সমাধান করার আশ্বাস দেয়া হয়।

এদিকে সদর উপজেলার ফকির নিটওয়্যার কারখানার তিন শতাধিক শ্রমিককে চাকরি থেকে ছাটাই করা হয়। পরে বিক্ষোভের মুখে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের জেলা সেক্রেটারি ইকবাল হোসেন জানান, শ্রমিক বিক্ষোভের পর শিল্প পুলিশ, মালিকপক্ষ ও শ্রমিক নেতাদের উপস্থিতিতে আইডি কার্ড ফেরত দেয়া ও ছাটাই বাতিল করা হয়।

শিল্প পুলিশ-৪ নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার আইনুল হক বলেন, শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করে আইডি কার্ড রেখে ছাটাই করার প্রতিবাদে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। পরে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধান করা হয়। তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আগে কিংবা পরে শ্রমিকদের বেতন অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। বেতন না দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

https://www.dailyinqilab.com/article/282760/