১৩ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ৫:০৫

করোনা সঙ্কটে বিশ্ব বাণিজ্যে যেভাবে পরিবর্তন আসবে

বিশ্বের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই অনেক সময় অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। প্রতিটি সমস্যাই আলাদা হলেও উদ্যোক্তা এবং সংস্থাগুলো প্রত্যেকবারই তার সাথে মানিয়ে নিয়ে সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে। তবে, বর্তমান সঙ্কটটি ব্যবসায়ীদের জন্য হতাশার। দেশগুলোতে চলমান লকডাউনের কারণে বিশ্বের জিডিপির ৫০ শতাংশেরও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, আগের মন্দার তুলনায় অনেক বেশি মারাত্মকভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পতন হচ্ছে।

লকডাউনগুলি থেকে বেরিয়ে আসার পথ অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। নিয়মিত গ্রাহকদের হারানো, অনিশ্চয়তার কারণে উৎপাদন দক্ষতা কমে যাওয়া ও নতুন স্বাস্থ্য বিধিমালার কারণে প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে উঠেছে। দীর্ঘকাল ধরে ব্যবসা করে আসা সংস্থালোকে সঙ্কট পরবর্তী সময়ের নতুন পরিবেশে দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং এর প্রতিক্রিয়া তিনটি প্রবণতা ত্বরান্বিত করবে। সেগুলো হচ্ছে- আরও কার্যকর নতুন প্রযুক্তির গ্রহণ, মুক্ত বাণিজ্যের জন্য বৈশি^ক সাপ্লাই চেইনলো থেকে অনিবার্য পশ্চাদপসরণ এবং সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের উত্থান।

গত মন্দার সময়ে বড় আমেরিকান সংস্থাগুলোর বিক্রি দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। সবচেয়ে খারাপ চতুর্থাংশে মিডিয়ান ড্রপ ছিল বাৎসরিক ১৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী তেলের চাহিদা এক তৃতীয়াংশ কমেছে; আমেরিকার রেলপথ দিয়ে গাড়ি ও যন্ত্রাংশের চালান ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অনেক সংস্থার কাছে প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য কেবল তিন থেকে ছয় মাসের পর্যাপ্ত রসদ এবং নগদ থাকে। ফলস্বরূপ তারা কর্মীদের ছাটাই বা ছুটি দিতে শুরু করেছে। গত ২৮ মার্চ ১ কোটি আমেরিকান বেকারত্ব ভাতার জন্য আবেদন করেছিলেন। ইউরোপে প্রায় ১০ লাখ সংস্থা নিষ্ক্রিয় কর্মীদের বেতনের জন্য রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দাবি করেছে। লভ্যাংশ এবং বিনিয়োগ কমানো হচ্ছে। কারখানা বন্ধ এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে বিশে^র অনেক প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। ইতালির লকডাউনের কারণে পনির থেকে জেট-টারবাইন সব উপাদানেরই বৈশ্বিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। হংকংয়ের সরকার বলেছে যে, বহুজাতিক সংস্থাগুলোর আদেশ বাতিল এবং বিল আটকে যাওয়ার কারণে দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যায় পড়েছে।

গত দুটি মন্দায়, বিশ্বব্যাপী প্রায় দশ শতাংশ মূলধন ভিত্তিক সংস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যেগুলো এখনও টিকে আছে তারাও তাদের শিল্প, মূলধন এবং সরকারী সাহায্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অনেক প্রযুক্তি সংস্থার চাহিদা বাড়লেও ছোট সংস্থাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমেরিকাতে ৫৪ শতাংশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অস্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে বা আগামী দশ দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পুঁজিবাজারে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। ছোট সংস্থাগুলোর জন্য মার্কিন সরকারের ৩৫০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্যাকেজের মাত্র ১.৫ শতাংশ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। ব্রিটেনেও এই প্রক্রিয়া ধীরভাবে চলছে। ব্যাংকগুলোও জটিল নিয়ম-কানুন এবং অসংখ্য লোনের আবেদন নিয়ে ধুঁকছে।

এই সঙ্কটগুলোর কারণে তিনটি প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। প্রথমত, নতুন প্রযুক্তিগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি। বিশ্ব্যাপি ই-বাণিজ্য, ডিজিটাল পেমেন্ট এবং রিমোট ওয়ার্কিংয়ের চাহিদা বাড়ছে। জিন-এডিটিং প্রযুক্তি সহ আরও নতুন চিকিৎসা উদ্ভাবন বৃদ্ধি পাবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাপী সরবরাহের চেইনগুলোর পরিবর্তন হবে, বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এগুলো আরও দ্রুততর হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন স্থানে থাকা কারখানাগুলো গুটিয়ে নিয়ে উচ্চতর স্বয়ংক্রিয় কারখানা ব্যবহার করে উৎপাদনে ঝুঁকে পড়বে, ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চাকরীর সুযোগ কমে যাবে। এই বছর সীমান্তে ব্যবসা বিনিয়োগ ৩০-৪০ শতাংশ কমে যেতে পারে। বৈশি^ক সংস্থাগুলোর লাভ কমলেও আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠবে। তৃতীয়টি হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদী আমদানি-রফতানি কম সুনিশ্চিত এবং আরও অবাঞ্ছিত হয়ে যাবে।

বর্তমানে বড় শিল্পপতিরা পারস্পরিক সহযোগিতা ও রাজনীতিবিদদের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। ভোটার, ভোক্তা এবং বিনিয়োগকারীদের এর বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত কারণ এটি আরও বেশি কলুষতা, কম প্রতিযোগিতা এবং ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সৃষ্টি করছে। সমস্ত সঙ্কটের মতোই কোভিড -১৯ বিপর্যয় কেটে যাবে এবং সময়ের সাথে সাথে ব্যবসায়ে শক্তির এক নতুন তরঙ্গ উন্মুক্ত হবে। তবে এগুলো সরকারের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা না পেলে এবং সংঘবদ্ধ চক্রের নিয়ন্ত্রণে না থাকলেই সবার জন্য ভাল হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/282768