১২ এপ্রিল ২০২০, রবিবার, ১:৫২

বিশ্বে প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু

ইতালিকে ছাড়িয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্র

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) থাবায় গোটাবিশ্ব বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে চলা তাণ্ডবে বিশ্বে মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ বড় হচ্ছে। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিশ্বে মৃতের সংখ্যা দ্বিগুণ এবং যুক্তরাষ্ট্রে শুক্রবার ২০৩৫ জন এবং শনিবার ১,৩২২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ইউরোপের দেশগুলোতেও করোনা তাণ্ডব অব্যাহত রয়েছে। ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি ভয়াবহ। এর মধ্যেই অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরাতে ইউরোপের কয়েকটি দেশ কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের উদ্যোগ নিয়েছে।

কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে বলেছে, করোনা সংক্রমণ রোধে লকডাউন, কারফিউয়ের মতো কড়াকড়ি ব্যবস্থা তড়িঘড়ি শিথিল করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। খবর বিবিসি, রয়টার্স, ইন্ডিয়া টুডে ও আলজাজিরার।

আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডওমিটারসে করোনা আপডেটে চোখ রাখলে বোঝা যায়, ভাইরাসটিতে মানুষ কত দ্রুত আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। কয়েক সেকেন্ড পরপর পরিবর্তন হচ্ছে সব সূচকের। করোনায় ৩ এপ্রিল বিশ্বে ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

আর এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ এপ্রিল সেখানে মৃতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কখনও মৃতের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়ে গেছে। চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি করোনার উপস্থিতি শনাক্ত হয়।

এখন পর্যন্ত ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। ওয়ার্ল্ডওমিটারসের হিসাব অনুযায়ী- শনিবার রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৬১ হাজার ২৮৬ জন। মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ৬৫৯ জন। সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৬৬৫ জন।

যুক্তরাষ্ট্রে মোট ২০,০৬৯ জন (শুক্রবার ২,০৩৫ ও শনিবার ১,৩২২ জন), ইতালিতে মোট ১৯,৪৬৮ জন (শুক্রবার ৫৭০ ও শনিবার ৬১৯ জন) ও স্পেনে মোট ১৬,৩৫৩ জন (শুক্রবার ৬৩৪ ও শনিবার ২৭২ জন), যুক্তরাজ্যে মোট ৯,৮৭৫ জন (শুক্রবার ৯৮০ ও শনিবার ৯১৭ জন), ফ্রান্সে ১৩,৮৩২ (শুক্রবার ৯৮৭ ও শনিবার ৬৩৫ জন), ইরানে মোট ৪,৩৫৭ জন (শুক্রবার ১২২ ও শনিবার ১২৫ জন), চীনে ৩,৩৩৯ (শনিবার ৩ জন) এবং ভারতে মোট ২৮৮ জন (শুক্রবার ৪০ ও শনিবার ৩৯ জন) মারা গেছেন।

ইতালিকে ছাড়িয়ে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র : ইতালিকে ছাড়িয়ে করোনায় প্রাণহানির শীর্ষে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। শনিবার রাত সাড়ে ১২টায় যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ হাজার ৬৯ জন। প্রাণহানির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইতালিতে মৃতের সংখ্যা ১৯ হাজার ৬৮৮ জন।

করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে এক দিনে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। শুক্রবার দেশটিতে ২১০৮ জন মারা গেছেন। ওয়ার্ল্ডওমিটারস ডট ইনফো’র হিসাব অনুযায়ী, এ ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছে পাঁচ লাখ ২১ হাজার ৮১৬ জন। আর ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৫২ হাজার ২৭১।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে ইতোমধ্যেই মৃতের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়েছে। সেখানে মৃতদের মধ্যে রয়েছেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশিও। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউসের করোনা টাস্কফোর্সের কর্মকর্তা ডা. ডেবোরা ব্রিক্স বলেছেন, ‘সংক্রমণ স্থিতিশীল হওয়ার মতো ভালো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।’

বেকারত্বের চাপে আমেরিকা, চাকরি হারাল দেড় কোটি লোক : প্রাণহানির পাশাপাশি করোনার সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে কর্মসংস্থানে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এক মাসে চাকরি হারিয়েছেন ১ কোটি ৭০ লাখ লোক। এ অবস্থায় অর্থনীতিকে বাঁচাতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বিভিন্ন ঋণ প্রোগ্রামের আওতায় ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।

দরিদ্র দেশে কর্মরত দাতব্য সংস্থাগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা দিচ্ছে : সান্তা বারবারার ডাইরেক্ট রিলিফের গুদাম থেকে জরুরি স্বাস্থ্য সামগ্রী গ্লাভস, মাস্ক ও ওষুধ এখন ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আলতোর স্ট্যানফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু আগে এখান থেকে অনেক কিছু সুদানে যেত।

ডাইরেক্ট রিলিফের মতো অনেক মার্কিন দাতব্য সংস্থা আগে যুদ্ধ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপদ্রুত দেশে কাজ করত। কিন্তু এখন দরিদ্র দেশ নয়, আজ তাদের সহায়তা দিতে হচ্ছে আমেরিকার সবচেয়ে ধনাঢ্য কিছু কমিউনিটিতে। স্বাস্থ্য দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (এমএসএফ) বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে।

নিউইয়র্ক অফিসের পাশেই তাদের সেবা দিতে হচ্ছে। একইভাবে সামারিটানের পার্স ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে আইসিইউ-সমেত ১৪টি ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা এখন দরিদ্র দেশগুলোতে নয়, আমেরিকায় কাজ করছে।

ব্রিটেনে ১৯ চিকিৎসক-নার্সের প্রাণহানি : রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ব্রিটেনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৯ চিকিৎসক ও নার্সের প্রাণহানি হয়েছে। শনিবার দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) ১৯ জন চিকিৎসক এবং নার্স মারা গেছেন।

লন্ডনের রয়াল কলেজ অব নার্সিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড্যাম ডোনা কিননায়ার বলেন, ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কাজ করার কারণে চিকিৎসক এবং নার্সরা মারা যাচ্ছেন না। বরং তারা মারা যাচ্ছেন যথাযথ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবে কাজ করার কারণে। করোনার ভয়াবহ মহামারীতে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) এবং অন্যান্য সরঞ্জামের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা ইতালির প্রধানমন্ত্রীর : করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিদ্যমান লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়েছে ইতালি। শুক্রবার টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে দেশটির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্টে এ ঘোষণা দেন।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ৩ মে পর্যন্ত দেশজুড়ে লকডাউন কার্যকর থাকবে। দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড শুরুর দাবি প্রত্যাখ্যান করে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন এ অনুমতি দেয়া হলে দেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

ব্রাজিলে মৃতের সংখ্যা এক সপ্তাহে তিনগুণ : সারা বিশ্বের মতো ব্রাজিলেও হু-হু করে বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। দেশটিতে মাত্র সাত দিনের ব্যবধানেই প্রায় তিনগুণ হয়েছে করোনায় মৃতের সংখ্যা। ব্রাজিলের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ৩ এপ্রিল সেখানে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৫৯ জন। মাত্র এক সপ্তাহ পরেই ১০ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৫৬ জন।

তুরস্কের ৩১ শহর লকডাউন : তুরস্কে ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ৯৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ নিয়ে দেশটিতে এখন পর্যন্ত এ রোগে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ৬। অপরদিকে দেশটিতে একদিনে নতুন করে আরও ৪৭৪৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহরেতিন কোচা জানান, এখন পর্যন্ত দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪৭ হাজার ২৯।

মদিনায় বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ : এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সৌদি আরবের পবিত্র মদিনা নগরীর কিছু এলাকায় চলাফেরার বিষয়ে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত পূর্ণকালীন (২৪ ঘণ্টা) লকডাউনের নির্দেশনা জারি করেছে মদিনা কর্তৃপক্ষ।

নির্দেশনা অনুযায়ী এলাকাগুলো হতে বের হওয়া বা প্রবেশ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। এমনকি ঘর থেকেও বের হওয়া যাবে না। শুক্রবার এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এলাকাগুলো হল- পবিত্র মদিনা নগরীর অভ্যন্তরীণ আস শুরাইবাত, বনী যুফার, কুরবান, আল জুময়া, আল ইসকান, বানী খুদরা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/297512