১১ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ২:০৩

প্রধান কারণ বায়ুদূষণ

করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি রাজধানীতে

বায়ুদূষণের কারণে রাজধানীতে করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যে শহরে দূষণ যত বেশি সে শহরে করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকিও তত বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশে^ কোভিড-১৯ সংক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের উল্লেখযোগ্য উচ্চ মৃত্যুহারের সাথে বায়ুদূষণের সম্পর্ক রয়েছে। বায়ুদূষণের মাত্রা সামান্য বাড়লেই ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যুহার বেড়ে যাচ্ছে; যা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার ঝুঁকি থাকায় করোনা রোগীর জন্য মারাত্মক হতে পারে। সুতরাং মানুষ ও যানবাহন না থাকায় আপাতত ঢাকার বাতাসে দূষণ কিছুটা কমলেও করোনা রোগীদের জন্য রাজধানী মোটেও ঝুঁকিমুক্ত নয়।

সরকারের পরিবেশ অধিদফতরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট-সিএএসই প্রকল্পের একিউআই আর্কাইভের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত বায়ুমান সূচকে ঢাকার বাতাসের মান ছিল ২০০-এর বেশি। কোনো কোনো দিন তা ৩০০ ছাড়িয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একিউআই ওঠে ৩৬৩ তে। তবে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর রাজধানীতে কমতে থাকে মানুষের চলাচল। সেইসাথে কমতে থাকে বায়ুদূষণের মাত্রা। ১৪ মার্চ ঢাকায় একিউআই নেমে আসে ১৮৩ তে, ১৫ মার্চ তা আরো কমে ১৬৯ হয়।

১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হলে দিনের প্রথম ভাগে রাস্তায় মানুষের চলাচল আরো কমে আসে। ২২ মার্চ সিএএসইর প্রকাশিত বায়ুমানে রাজধানীর বাতাসের একিউআই ছিল ১৫৮। বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ভারী বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) হিসাব করে যে বায়ুমান সূচক (একিউআই) তৈরি করা হয়, তাতে বর্তমানে দুপুর থেকে বিকেলে রাজধানীর বাতাসের মান থাকছে ৯০ থেকে ১১০ এর মধ্যে। রাতে তা বেড়ে ১৬০ বা ১৭০ হচ্ছে।

অন্য দিকে আইকিউএয়ার কোয়ালিটির ‘লাভই এয়ার কোয়ালিটি (একিউআই) সিটি র্যাং কিং’ বলছে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় বিশ্বের বেশির ভাগ শহরের বায়ুর মান বিপজ্জনক ও খুবই অস্বাস্থ্যকর ক্যাটাগরিতে না থাকলেও ১১টি শহর ছিল অস্বাস্থ্যকর ক্যাটাগরিতে। যার মধ্যে রাজধানীর বায়ুর মান ১৬৫ পিএম ২.৫ নিয়ে ছিল দূষণের চার নম্বরে, যা ছিল মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান করোনা রোগীদের জন্য রাজধানী ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বায়ূদূষণের কারণে মানুষের মধ্যে যে সব উপসর্গ দেখা দেয় বলতে গেলে তার সবই করোনা রোগীর মধ্যে থাকে। তা ছাড়া রাজধানীতে বসবাসকারীরা সব সময়ই শারীরিকভাবে একটু দুর্বল থাকেন। কারণ বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাস করতে করতে এক পর্যায়ে আমাদের সবার মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। তাতে অল্পতেই আমরা কাহিল হয়ে পড়ি। সুতরাং রাজধানী শহরের বায়ুদূষণের কারণে করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। তিনি বলেন, শুধু রাজধানী নয়, বিশে^র যেসব শহরে বায়ুদূষণ আছে, সে শহরেই করোনায় আক্রান্তরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।

অপর দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর ডা: আবুল কালাম আজাদ জানান, কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তার মধ্যে যে উপসর্গ থাকে তার অন্যতম শ্বাসকষ্ট। আর স্বাভাবিক সময়ে শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণের একটি হলো পরিবেশ দূষণ। তাই করোনা রোগীদের জন্য এই পরিবেশ দূষণও বড় একটি ঝুঁকির কারণ। অন্য দিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের উল্লেখযোগ্য উচ্চ মৃত্যুহারের সাথে বায়ুদূষণের সম্পর্ক রয়েছে বলে সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের হার্ভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষকরা এ গবেষণা করেছেন।

এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৩ হাজার মার্কিন কাউন্টির ৯৮ শতাংশ জনসংখ্যা নিয়ে করা গবেষণায় বায়ুদূষণ এবং কোভিড-১৯ এ মৃত্যু বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। এতে দেখা গেছে, বায়ুদূষণের মাত্রা সামান্য বাড়লেই ১৫ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যুহার বেড়েছে। অন্য দিকে ম্যানহাটানে বায়ুদূষণের মাত্রা কম থাকায় শত শত মানুষ বেঁচে গেছে। গবেষকরা দাবি করেন, দেশজুড়ে বিষাক্ত বায়ু স্তরের বিশাল পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে গবেষণাটি প্রমাণ করেছে দূষিত বায়ু অঞ্চলের লোকের তুলনায় তুলনামূলক কম দূষিত বায়ুর অঞ্চলে বাসকারীদের মারা যাওয়ার আশঙ্কা কম। দূষিত বায়ু শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বাড়ানোর পাশাপাশি কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এর পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের অন্যান্য সমস্যার কারণও হতে পারে।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনালি দেখলাম দূষণের মাত্রা কমেছে। সাধারণত অন্যান্য সময় আমাদের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ২০০-এর ওপরে থাকে। সেখানে এখন মোটামুটি দেড় শ’র কাছাকাছি আছে।’ তবে তাতে স্বস্তির কিছু দেখছেন না তিনি। কারণ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানীর নাম ওপরের দিকেই থাকছে বেশ কিছুদিন ধরে। শীত এলেই নাক-চোখ ও শ্বাসতন্ত্রের অসুখ নিয়ে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে দূষণ কমাতে উচ্চ আদালতকেও গত দেড় বছরে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ দিতে হয়েছে। তাই স্বাভাবিক সময়ে ঢাকার বায়ুমান স্বাস্থ্যকর রাখতে তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেন। তিনি বলেন, যানবাহন চলাচল এবং নির্মাণকাজ কমে যাওয়ার কারণে দিনে এখন দূষণের মাত্রা কমেছে। ট্রাক চলার কারণে দিনের তুলনায় রাতে দূষণ একটু বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বায়ুদূষণ থেকে আপাতত রক্ষা পেয়েছি, কিন্তু তা তো ঠিক না। রাস্তায় মানুষ বাড়লেই এটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে। দূষণের উৎসগুলো দমন করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কতগুলো শিল্পকারখানা থাকবে, দূষণ কতটুকু হবেÑ এগুলোর পরিকল্পনা তো সরকারের নেই। শিল্পকারখানা করলেন, তার জন্য তো বিজ্ঞানভিত্তিক বর্জ্যনিষ্কাশন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/494969/