হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ কেউ হেঁটে, কেউ পিকআপ ও ট্রাকে চড়ে ছুটছেন কর্মস্থলের দিকে - সমকাল
৪ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ১:০১

লোকালয়

মহাসড়কে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের স্রোত

রোববার খুলছে গার্মেন্ট। করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি নিয়েই কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন কর্মীরা। মহাসড়কে দেখা যাচ্ছে মানুষের স্রোত। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :

গাজীপুর :পোশাক কারখানার শ্রমিক স্বামীহারা কুলসুম আক্তার নয় বছরের একমাত্র ছেলে সাফিনকে নিয়ে শেরপুর থেকে হেঁটে গাজীপুরের মাওনার ভাড়া বাসায় এসেছেন। আগামীকাল রোববার কারখানা খুলবে এবং গেল মাসের বেতন পাবেন এ আশায় দীর্ঘপথ হেঁটে ১২ ঘণ্টায় শুক্রবার সন্ধ্যার পর মাওনার বাসায় পৌঁছেন। টানা হাঁটা নয়, মাঝেমধ্যে ছোটখাটো যানবাহনেও চড়েছেন। পরিবর্তন করেছেন ১১টি গাড়ি। হেঁটেছেন ৩০ কিলোমিটারেরও বেশি সময়। শুধু কুলসুমই নন, তার মতো হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে কেউ হেঁটে, কেউ আবার পিকআপ ও ট্রাকে চড়ে ছুটেছেন ঢাকা ও গাজীপুরের দিকে। শুক্রবার রাজধানীমুখী মানুষের স্রোত নামে এ মহাসড়কে। রাহাত মণ্ডল নামে এক শ্রমিক জানান, তিনি এসেছেন ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে। গাড়ি নেই, তাই হেঁটে যাচ্ছেন ঢাকা। কারণ বন্ধের দিন কারখানা থেকে বলে দেওয়া হয়েছে রোববার কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে হবে। কিছুদূর হেঁটে ও কিছুদূর রিকশায় চড়ে গাজীপুর পর্যন্ত এসেছেন তিনি। একই রকম পরিস্থিতি অন্য শ্রমিকদেরও। করোনাভাইরাসের ভয়কে সঙ্গী করেই তারা আবার ফিরে যাচ্ছেন কর্মস্থলে।

মহাসড়কে দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলাচল না করার কারণে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন নিম্ন আয়ের এসব মানুষ। মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়।

সচেতন মহল বলছেন, শ্রমজীবী এ মানুষগুলো বাড়ি ছেড়ে ঢাকা কিংবা গাজীপুর আসায় নিরাপত্তা ঝুঁকিটা আরও বেড়ে গেল। কষ্ট করে যেহেতু গ্রামে চলেই গিয়েছিলেন, সেখানে থাকাটাই ভালো ছিল।

শ্রীপুর থানার ওসি মো. লিয়াকত আলী জানান, শুক্রবার ভোর থেকেই শ্রমজীবী মানুষের ঢল নামে মহাসড়কে। সন্ধ্যার পরও বিপুল সংখ্যক মানুষ হেঁটে ও পিকআপে ঢাকার দিকে যাত্রা করতে দেখা যায়।

ত্রিশাল (ময়মনসিংহ) :করোনা আতঙ্কে বন্ধ ছিল গার্মেন্ট কারখানা, তাই বাড়ি চলে এসেছিলাম। রোববার থেকে আবার খুলছে গার্মেন্ট কারখানা। ঠিক সময়ে কর্মস্থলে না গেলে হারাব চাকরি। জীবিকার তাগিদে আতঙ্কের মধ্যেই রওনা হয়েছি। সব ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছি। চাকরি চলে গেলে তিন সন্তান নিয়ে কী খেয়ে বেঁচে থাকব। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কথা হওয়ার পর এমনটাই জানালেন স্বামীহারা চল্লিশোর্ধ্ব জুলেখা খাতুন।

কোনো গণপরিবহন না থাকায় বেশি ভাড়া দিয়েই তিনি উঠেছিলেন একটি পিকআপ ভ্যানে। কিন্তু সেখানে বাদ সাধে পুলিশ। গাড়ি থেকে সব যাত্রী নামিয়ে জরিমানা করা হয় গাড়িচালককে। জুলেখার আর গাড়িতে ওঠা হলো না। আবার হাঁটা শুরু করেন মহাসড়ক ধরে। যেখানে গাড়ি পাবেন সেখান থেকেই গন্তব্যে পৌঁছার জন্য গাড়িতে উঠবেন। মহাসড়কে জটলা দেখলেই কিছুক্ষণ পর পর ধাওয়া দিয়ে যাত্রীদের সরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ।

শুক্রবার সকাল থেকে দিনভর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকাগামী যাত্রীদের জটলা লেগেই ছিল। দূরপাল্লার কোনো গাড়ি না থাকায় পিকআপ ভ্যান, মাইক্রোবাস, ট্রাক, লেগুনাসহ অন্যান্য ছোট যানবাহনে তিনগুণ ভাড়া দিয়ে গন্তব্যস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন যাত্রীরা। তাদের মধ্যে অধিকাংশের রোববার থেকে খোলা থাকবে অফিস। একদিন আগে থেকেই কর্মস্থলে পৌঁছার জন্য ৫/১০ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে মহাসড়ক পর্যন্ত পৌঁছে দুর্ভোগ আর ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে ঢাকামুখী যাত্রীদের। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশের টহল টিম থাকায় আরও এক কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হচ্ছে গুলশান সিনেমা হলের সামনে।

করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা আপনাকে কেন ঘরে আটকে রাখতে পারল না তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঠিক সময়ে অফিসে না গেলে চাকরি হারাব। পেটের তাগিদেই ঢাকা রওনা হয়েছি। সব ভয় উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছি।

এ সময় উপজেলার করিম মোল্লা, আনোয়ার, ফজল বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের ঘরে থাকতে বলা হয়েছিল। তবু আমরা বের হয়েছি। যেহেতু অফিস খোলা, আমাদের যোগদান করতেই হবে। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ, বাইরে বের হয়ে গাড়ি পাচ্ছি না। যত কষ্টই হোক, যে কোনো যানেই হোক আমাদের ঢাকায় পৌঁছতে হবে।

দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা এসআই আবদুল কাইয়ুম জানান, সকাল থেকেই ঢাকামুখী মানুষের ঢল নেমেছে। আমরা মানুষের জটলা দেখলেই তাদের সরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ধাওয়া খেয়ে যাত্রীরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে আবার একসঙ্গে জড়ো হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

শিবালয় (মানিকগঞ্জ) :করোনাভাইরাসের ঝুঁকি নিয়েই কর্মস্থল ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন গার্মেন্ট কর্মীরা। আজ শনিবার থেকে ঢাকার অনেক গার্মেন্ট খোলা থাকার কারণে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি থেকে যাত্রীরা কর্মস্থলে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। যাত্রীরা জানান, গার্মেন্ট আজ শনিবার থেকে খোলা থাকার কারণে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যেই কর্মস্থল ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন।

যাত্রীরা গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকায় কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাটে এসে ভিড় করছেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রীরা ফেরিতে ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পদ্মা-যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে আরিচা ও পাটুরিয়া ঘাটে আসেন। কিন্তু গণপরিবহন যাত্রীবাহী বাসসহ সব ধরনের যানবাহন বন্ধ রয়েছে। তাই যাত্রীরা যানবাহন না পেয়ে ঘণ্টার ঘণ্টা ঘাটেই বসে অপেক্ষা করছেন। কিছু যাত্রী ২০-৩০ টাকার ভাড়ার স্থলে দুই তিনশ' টাকা ভাড়া দিয়ে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যাচ্ছেন। তবে বেশির ভাগ যাত্রী ১০-১২ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে ঢাকার দিকে রওনা হচ্ছেন। করোনাভাইরাসের আতঙ্ক মাথায় নিয়েই সারিবদ্ধভাবে যেতে হচ্ছে তাদের। আবার অনেকে গাদাগাদি করে রিকশা ও ভ্যানে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যাচ্ছেন।

শিবালয় থানার ওসি সিজানুর রহমান জানান, আমরা সরকারের বিধিনিষেধ পালন করছি। মাইকিং করে এক সঙ্গে দুই-তিনজনকে চলাচলে নিষেধ করছি। করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করছি। যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

https://www.samakal.com/todays-print-edition/tp-lokaloy/article/200434939