৩ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার, ১:৪৮

করোনার বিরূপ প্রভাব

ক্রয়ক্ষমতা কমছে পৌনে দুই কোটি মানুষের

নিত্যপণ্য কিনতে দিনমজুররা দিশেহারা * বাড়িভাড়া নিয়ে শঙ্কা * অনেকে ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন

রাজধানীর আদাবরের ইদ্রিস মোল্লা (৫০) রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন গড়ে পকেটে নিতেন ৬শ’ টাকা। একশ’ টাকা রিকশার মালিককে দিতেন। আর ২শ’ টাকা ঘর ভাড়ার জন্য জমিয়ে রাখতেন। বাকি ৩শ’ টাকা ব্যয় করতেন তার পাঁচ সদস্যের সংসারে। এ টাকায় প্রতিদিন কেনাকাটা করতেন নিত্যপণ্য।

বুধবার বিকালে ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডে ইদ্রিসের সঙ্গে আলাপ হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি উল্লিখিত সব তথ্য দিয়ে আরও জানান, প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে বসা, কিন্তু কোনো যাত্রী নেই। এখন আয় একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকায় নেমেছে। অর্থাৎ তার প্রতিদিনের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে প্রায় সাড়ে চারশ’ টাকা। তিনি বলেন, ‘এখনের আয় দিয়া দিনের বাজারও হয় না, রিকশা মালিকের জমাটাও দেয়া যায় না, বাসা ভাড়া দিমু কেমনে, জানি না।’

একই অবস্থা মাদারীপুর শিবচর কাদিরপুর ইউনিয়নের দিনমজুর ইসলামের। করোনা সংক্রমণ রোধে চলমান ‘লকডাউন’য়ে তারও ক্রয় ক্ষমতা কমেছে সাড়ে ৪শ’ টাকা। দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে গড়ে ৫শ’ টাকা আয় ছিল তার। এখন ৫০ টাকাও রোজগার হচ্ছে না। শুধু ইদ্রিস ও ইসলামই নয়, তাদের মতোই ক্রয় ক্ষমতা কমেছে দেশের প্রায় পৌনে দুই কোটি দিনমজুরের। তারা সবাই দৈনিক ও সাপ্তাহিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাবে এ আশঙ্কা করেছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। মঙ্গলবার অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি বলেছেন, বিশ্বের অর্থনীতি করোনার প্রভাবে কিরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দীর্ঘ ছুটি বা কার্যত লকডাউনের ফলে রফতানিমুখী শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কুটির শিল্পসহ উৎপাদনমুখী সব প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পরিবহন সেবা ব্যাহত হচ্ছে। নানা কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও হ্রাস পাবে।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘লকডাউন’র কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমবে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জেলা প্রশাসকরা প্রান্তিক মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা দিচ্ছেন। কিন্তু লকডাউন দীর্ঘমেয়াদি হলে সহায়তা অব্যাহত রাখার বিষয়টি সরকার ভালো বলতে পারবে। আমি মনে করি, মানুষের জন্য কর্মসৃজন সৃষ্টি করতে হবে। প্রয়োজনে ‘পুকুর কেটে আবার সে পুকুরে মাটি ভরাট করে’ হলেও কর্মসৃজন করতে হবে। উন্নত বিশ্বে তাই করা হয়। বসিয়ে তো পয়সা দেয়া যাবে না। তাই এটি করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করছেন প্রায় ৮৩ লাখ ৩২ হাজার জন, সাপ্তাহিক মজুরিতে কাজ করছেন ১৭ লাখ ৭২ হাজার শ্রমিক। এছাড়া কৃষি খাতে রয়েছে প্রায় ৭২ লাখ ৯২ হাজার মজুর। অর্থাৎ দৈনিক, সপ্তাহিক ও কৃষি খাতসহ মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ শ্রমিক রয়েছেন। এসব দিনমজুর সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে বেরিয়ে পড়েন। কাজ শেষে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের ও পরিবারের নিত্যপ্রয়োজন মেটান। পরের দিন আবার কাজের সন্ধানে ছোটেন। এদের নেই কোনো সঞ্চয়। ৮ মার্চ থেকে বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের প্রথম আঘাতটা নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরই এসেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। দ্বিতীয় দফা বাড়িয়ে এটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত করেছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। সবকিছু থমকে থাকায় কাজে বের হতে পারছেন না কুলি-মজুর, নির্মাণ ও আবাসন শ্রমিকসহ ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষের। কয়েক দিন ধরে কর্মহীন জীবন পার করছেন নিম্ন আয়ের এসব মানুষ। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়া তাদের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে।

বুধবার মোবাইল ফোনে কথা হয় পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার অঞ্চলের অটো সিএনজি চালক নুরুল আলমের সঙ্গে। করোনায় তার ক্রয় ক্ষমতা কমেছে ৬শ’ টাকা। পর্যটকদের নিয়ে প্রতিদিন কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে আয় ছিল ৬শ’ থেকে ৭শ’ টাকা। এখন পর্যটকও নেই, অপরদিকে গাড়ি বের করলে পুলিশি লাঠিচার্জ করে। তিনি বলেন, কক্সবাজার টেকপাড়ায় ৫ হাজার টাকা ভাড়া বাসায় ছেলেমেয়েসহ ৫ জন বাস করছেন। কিন্তু মাস শেষে বাসা ভাড়া কীভাবে দেবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, একবেলা উপোস থাকলেও কেউ জানবে না। কিন্তু বাড়ি ভাড়া না দিয়ে থাকা যাবে না।

ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের খলিফার ঘাটের আনিস মিয়া পেপার বিলি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। করোনার প্রভাবে তার ক্রয় ক্ষমতা হারিয়েছে ২শ’ টাকা। প্রতিদিন ১২শ’ পেপার বিলি করতেন। কিন্তু করোনার কারণে পত্রিকা নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক গ্রাহক। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ৪শ’ কপি বিলি করতে পারছেন। তিনি বলেন, ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কষ্ট হলেও লজ্জায় কারও কাছে হাত বাড়াতে পারছি না।

ঢাকায় প্রায় সাত লাখ রিকশাচালক রয়েছেন। দৈনিক রিকশা চালিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। মানুষ বাসা বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। যে কারণে তাদের আয়ে বড় ধরনের আঘাত আসায় ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। একইভাবে নির্মাণ খাতে রয়েছেন প্রায় ৩৬ লাখ শ্রমিক। এসব শ্রমিকের অধিকাংশই ‘সাব-কন্ট্রাক্টের’ মাধ্যমে কাজে যুক্ত হন। অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন। এর মধ্যে রয়েছেন- রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রডমিস্ত্রি, সুপারভাইজার, টেকনিশিয়ান, ইলেকট্রিশিয়ান, মেশিন অপারেটর ও হেলপার কিংবা শাটার মিস্ত্রি। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে তাদের প্রায় সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ বা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। যে কারণে তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে।

এছাড়া দেশে ২৬ হাজারের বেশি বাস-মিনিবাস, ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি ট্রাক-পিকআপ রয়েছে। এছাড়া রাইডশেয়ারের মাধ্যমে পরিবহন শ্রমিকরা কাজ করছেন। পাশাপাশি টিকিট কাউন্টার পরিচালনা, রুট পরিচালনাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন অনেকে। পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের হিসাবে, সারা দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত পরিবহন শ্রমিকের সংখ্যা ৫২ লাখের বেশি। যাদের এ সময় প্রাণঘাতী করোনার প্রকোপ কেড়ে নিয়েছে ক্রয় ক্ষমতাকে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ জানান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। এ অবস্থায় নিম্ন আয় ও খেটে খাওয়া মানুষ যাদের কিনা সঞ্চয় নেই, তাদের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে! দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষদের খাদ্য ও বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও যেন না থাকে, সেটি সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে। সব মিলিয়ে একটি সমন্বি^ত উদ্যোগ খুব দ্রুত গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/city/295262