বরিশালের বিভিন্ন রুটে চলাচলরত মেয়াদোত্তীর্ণ ফেরি
১৩ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৯:৩৬

পারাপারে দুর্ভোগ

দক্ষিণাঞ্চলের ১৮ ফেরি মেয়াদোত্তীর্ণ

দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক ও জনপথ বিভাগের ১৮টি ফেরির সবগুলোই মেয়াদোত্তীর্ণ। নতুন ইঞ্জিন না কেনায় মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন মেরামত করে সচল রাখা হচ্ছে ফেরি সার্ভিস। তবে এসব ইঞ্জিন অহরহ বিকল হওয়ায় দুর্ভোগে পড়ছেন যাত্রীরা।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ফেরির ইঞ্জিনের মেয়াদ কোনোটার এক দশক কোনোটার দেড় যুগ পার হয়েছে। সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় আরো কয়েকটি ঘাটে ফেরির চাহিদা থাকলেও জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে সঙ্কট নিরসনে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) জমা দেয়া হয়েছে। এক বছরের মধ্যে নতুন ইঞ্জিন পাওয়া যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন সওজ-এর ফেরি রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের বরিশাল সার্কেলের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো: শামসুল হক।

সওজ-এর বরিশাল সার্কেলের তথ্যানুযায়ী, বরিশাল জেলায় লক্ষ্মীপাশা, গোমা, নেহালগঞ্জ, বেলতলা, মীরগঞ্জ ও বানারীপাড়ায় ছয়টি ফেরি রয়েছে। পিরোজপুর জেলার চরখালী, বেকুটিয়া ও আমড়াঝুড়িতে ফেরি চলাচল করছে তিনটি। পটুয়াখালী জেলার লেবুখালী, বগা, গলাচিপা, পায়রাকুঞ্জ ও নলুয়াবাহেরচর মিলিয়ে ফেরি রয়েছে পাঁচটি। বরগুনা জেলার আমতলী ও বড়ইতলীতে দুইটি ফেরি চলছে। আর ঝালকাঠী জেলার ষাটপাকিয়া ও আমুয়াতে রয়েছে দুইটি ফেরি। এর মধ্যে লেবুখালী, চরখালী, আমতলী ও বেকুটিয়া ব্যস্ততম ফেরিঘাট। এ ঘাটগুলো দিয়ে ২৪ ঘণ্টাই যানবাহন পারাপার হয়। এ ঘাটগুলোতে ৩১৫ অশ্বশক্তির ইউটি টাইপ-১ ফেরি রয়েছে। অন্যগুলোয় ২০০ অশ্ব শক্তির ইউটি টাইপ-২ ফেরি চলাচল করছে।

ফেরি রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলীর দেয়া তথ্য মতে, ইংল্যান্ডে নির্মিত ফেরির ইঞ্জিন বেশির ভাগই ১৯৮০ থেকে ৮২ সালের মধ্যে আনা হয়েছিল। সাড়ে তিন দশক পার হওয়াতে ইঞ্জিনের সিলিন্ডার, পিস্টন, লার্নারে সমস্যা বেশি দেখা দিয়েছে। ২৫ বছর পার হলেই ইঞ্জিনের অশ্বশক্তি কমে আসে। এ জন্য কখনো কখনো স্রোতের বিপরীতে ফেরিগুলো কুলিয়ে ওঠে না। বাড়তি চাপ পড়ায় ইঞ্জিন সিজ হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে ফেরি বিকল হয়।

চরখালি, বেকুটিয়া, আমড়াঝুড়ি ঘাটের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম জানান, গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোর জন্য বাড়তি ইঞ্জিন মেরামত করে রাখেন তারা। নতুন ইঞ্জিন পাওয়া যাচ্ছে না বলে পুরনো ইঞ্জিন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ করে যন্ত্রাংশ লাগিয়ে চলাচলের উপযোগী করা হয় যা আবার দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যেই বিকল হয়ে যায়। তিনি আরো জানান, খরচ বাঁচাতে ইজারাদারদের সময়মতো ইঞ্জিনের মবিল পরিবর্তন না করার কারণেও ইঞ্জিন বিকল হচ্ছে।
উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শামসুল হক বলেন, কেবল ইঞ্জিন নয়, ফেরির অবকাঠামোও জরাজীর্ণ হয়ে পরেছে। ৩১৫ অশ্বশক্তির ইউটি টাইপ-১ ফেরির ধারণ ক্ষমতা ১১০ টন যা ১২টি গাড়ি বহন করতে পারে। আর ২০০ অশ্ব শক্তির ইউটি টাইপ-২ ফেরির ধারণক্ষমতা রয়েছে কেবল ৭০ টন। এ ফেরি গাড়ি নিতে পারে মাত্র ছয়টি। বর্তমানে পাথর বা রডবাহী ট্রাকের ওজন হয় প্রায় ৪০ টন। অতিরিক্ত মালবহন করতে গিয়েই ফেরিগুলো দ্রুত কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। গুরুত্ব বিবেচনা করে চরখালীঘাটে নতুন ফেরি দেয়া হয়েছে জানিয়ে শামসুল হক বলেন, স্বরূপকাঠি, শ্রীরামকাঠী, বেতাগি ও কাঁঠালিয়া উপজেলার মাঝখানে একটি ফেরি এবং মেহেন্দিগঞ্জ আর হিজলা উপজেলায় একটি করে নতুন ফেরির আবেদন আছে। এ জন্য মন্ত্রণালয়ে নতুন ফেরির জন্য প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এক বছরের মধ্যে নতুন ফেরি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ব্যস্ততম ঘাটগুলোয় সময় উপযোগী ৩০০ টন ধারণ ক্ষমতার ফেরি সরবরাহ করা উচিত বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

ফেরি বিকল হয়ে দুর্ভোগে পড়া পিরোজপুর থেকে আসা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানিয়া তাবাসসুম জানান, বেকুটিয়ার ফেরি বিকল হওয়ায় তারা পাঁচ ঘণ্টা আটকে ছিলেন। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় যতক্ষণ ফেরি সচল না হয়েছে ততক্ষণ তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। কুয়াকাটাগামী যাত্রী আফজাল হোসেন বলেন, বরিশাল থেকে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা যেতে এখন শুধু লেবুখালিতে ফেরি রয়েছে। এ ফেরিটি প্রায়ই বিকল হওয়ায় তারা ট্রলারে নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে ওঠেন, কখনো বা বিকল্প পথে বাড়তি টাকা খরচ করে তাদের গন্তব্যে যেতে হয়। আমতলী হয়ে বরগুনাগামী যাত্রী সোহরাব হোসেন বলেন, ফেরি বিকল হলে প্রমত্তা পায়রা নদীতে ট্রলারে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হয় যাত্রীদের। কাজের তাড়া থাকায় জীবনের ঝুঁকি নেয়া ছাড়া তাদের কিছুই করার থাকে না।

কেবল যাত্রীরাই নয়, ফেরি বিকল হলে ভোগান্তি পোহাতে হয় বাস চালকদেরও। মো: রবিউল নামে এক বাস চালক বলেন, বেকুটিয়া আর চরখালী ফেরিঘাটে দুটি করে ফেরির প্রয়োজন। সেখানে একটি করে ফেরি চলাচল করে। আবার ফেরি ছাড়ার বিষয়টিও ইজারাদারের মর্জির ওপর নির্ভর করে। ইঞ্জিন বিকল হলে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়। এতে কখনো কখনো যাত্রীদের সাথে বচসা থেকে বাসের সুপারভাইজারদের সাথে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর এই সুযোগে যাত্রীদের কেউ কেউ ট্রলার বা নৌকায় পার হয়ে ভাড়া না দিয়েই চলে যায়।

পাথরঘাটার মাছ ব্যবসায়ী লিটন মিয়া বলেন, বরগুনা, পাথরঘাটার মাছ ব্যবসায়ীরা সড়ক পথে চরখালীর ফেরি পার হয়ে খুলনা বা অন্যত্র মাছের চালান পাঠিয়ে থাকে। ফেরি বিকল হলে তাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। এতে গন্তব্যে পৌঁছতে বিলম্ব হওয়ায় মাছের কাক্সিক্ষত বাজার দর পাওয়া যায় না। তাই বিকল্প ফেরির ব্যবস্থা রাখার দাবি করেন এ ব্যবসায়ী। একই অবস্থা বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ ফেরিঘাটের।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/203152