১৮ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১০:৫৯

গতি হারিয়েছে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড

সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতি হারিয়েছে। নানামুখী উদ্যোগেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি আনতে পারছে না সরকার। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাস পেরোলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সিকিভাগও বাস্তবায়ন হয়নি। বাজেটে অনুমোদিত ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪১ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। এদিকে ভারতের সঙ্গে ঋণচুক্তির আওতায় (এলওসি) নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে পারছে না সরকার। নয় বছরে তিনটি চুক্তির আওতায় ৭৩৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের চুক্তি হলেও ছাড় হয়েছে মাত্র ৫৬ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। সরকার এ ক্ষেত্রেও আশানুরূপ ভারতীয় ঋণ ছাড় করাতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া মেগা প্রকল্পের কাজে গতি আনতে পারছে না সরকার। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন ও পরীবিক্ষণ বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি তহবিল থেকে ২৯ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, প্রকল্প সহায়তার থেকে মাত্র ১১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা ও সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত এডিপির মাত্র ১৯ দশমিক ২৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ। বাজেটে অনুমোদিত ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৪১ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশি বরাদ্দ পাওয়া ১০ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। যোগাযোগ খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয় উন্নয়নে ব্যয় করেছে মাত্র ৯৪০ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দেশের রেলপথের উন্নয়নে এবার এই মন্ত্রণালয়কে ১২ হাজার ১১০ কোটি টাকা বা মোট বরাদ্দের প্রায় ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের শুরুতে বর্ষার জন্য আমরা প্রকল্পের কাজ তেমন এগিয়ে নিতে পারিনি। নভেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়ন কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও এরপর থেকে কাজের গতি অনেক বেড়েছে। অর্থবছর শেষে প্রকল্পের অগ্রগতি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

এদিকে ভারতের সঙ্গে ঋণচুক্তির আওতায় (এলওসি) নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে পারছে না সরকার। নয় বছরে তিনটি চুক্তির আওতায় ৭৩৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের চুক্তি হলেও ছাড় হয়েছে মাত্র ৫৬ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। ঋণচুক্তির সমন্বয়ক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে থেকে এতথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তিনটি ঋণ চুক্তির আওতায় ৪৭টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। প্রথম ঋণচুক্তির আওতায় ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার দিয়ে ১৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে নয় বছরে ছাড় হয়েছে ৫৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার; তিনটি প্রকল্প এখনও বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার।

এবিষয়ে জানতে চাইলে ইআরডি এক কর্মকর্তা জানান, প্রথম ঋণচুক্তির আতওতায় শেষ না হওয়া প্রকল্পগুলোতে জমি অধিগ্রহণ ও বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে জটিলতা ছিল। সেগুলোর সমাধান হয়েছে। দ্বিতীয় ঋণচুক্তির আওতায় ২০০ কোটি ডলারের মধ্যে ৩ কোটি ২৮ লাখ ডলার ছাড় হয়েছে। সাড়ে তিন বছর আগের এ ঋণচুক্তির আওতায় নেওয়া ১৬টি প্রকল্পের একটিরও কাজ শুরু হয়নি। আবার তৃতীয় ঋণচুক্তির আওতায় কোনও অর্থ ছাড় শুরু হয়নি। প্রায় দুই বছর আগে ৪৫০ কোটি ডলারের এ চুক্তির আওতায় গৃহিত ১৬ প্রকল্পের কোনোটির কাজ শুরু হয়নি।

ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, ভারতীয় এলওসির আওতায় নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা দূর করে কাজে গতি আনতে যৌথভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রথম এলওসি: প্রথম এলওসির আওতায় ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার দিয়ে ১৫টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১২টি প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হয়েছে। বাকী তিনটি প্রকল্প এখনো শেষ করা সম্ভব হয়নি। এগুলো সবই রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীন। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত প্রথম এলওসির মোট অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ৫৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা মোট ঋণের ৬২ দশমিক ১৮ শতাংশ।

বাস্তবায়ন না হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে খুলনা-মোংলা রেল লাইন নির্মাণের কাজ কাজই শুরু হয় ২০১৬ সালে। এটার কাজ ২০১৮ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মেয়াদ সংশোধন করে ২০২১ সালের জুন মাস লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের কাজ গত বছর জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সংশোধন করে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে জুন ২০২৩ সাল পর্য়ন্ত। এছাড়া কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন রেলপথ পুনর্বাসনের কাজও গত বছরের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তা পিছিয়ে চলতি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষ করা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

ইআরডির এক কর্মকর্তা জানান, খুলনা-মোংলা রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৫৪ শতাংশ। প্রকল্পটিতে এখনো ভূমি অধিগ্রহণ বাকি আছে। এছাড়া রূপসা সেতুর কারণে প্রকল্পের নকশায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে; সেতু নির্মাণে পাইলিংয়েও কিছু সমস্যা রয়েছে। আর ঢাকা-টঙ্গী ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতার সঙ্গে ওই রুটে একটি এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় তা বেড়েছে।

দ্বিতীয় এলওসি: ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ২০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় এলওসির আওতায় নেওয়া ১৬টি প্রকল্পের মধ্যে ১৩টি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চুড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দুটি প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

এছাড়া কেরানীগঞ্জ ও মিরসরাইয়ে ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব ঢাকা আইটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন (এসইজেড) নির্মাণ’ প্রকল্পটি যৌথ সভায় বাদ দিয়ে ‘ডেভেলপমেন্ট অব ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর’ শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় এলওসি: ২০১৭ সালের অক্টোবরে তৃতীয় এলওসির আওতায় সড়ক পরিবহন, রেলপথ, নৌপরিবহন, বেসামরিক বিমান পরিবহন, স্থানীয় সরকার ও টেলিটকের ১৬টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে একনেক সভায় চারটি প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, ৫টি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে, আর চারটি প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া কাটিহার-পার্বতীপুর-বরনগর ৭৬৫ কেভি আন্তঃসংযোগ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন প্রকল্পটির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যৌথ সভায়।

এছাড়া মেগা প্রকল্পের কাজে গতি আনতে পারছে না আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর টানা ক্ষমতায় রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করে তারা। সরকারের এই মেগা প্রকল্পগুলো হচ্ছে- পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লাভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ খুব বেশি দূর এগোয়নি।

পদ্মা সেতু : সরকারের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পদ্মা সেতু প্রকল্প। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পদ্মায় মূল সেতুর কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। বিদায়ী বছরের শেষ দিন পর্যন্ত সেতুর বিশটি স্প্যান বসানো হয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল এই সেতুর ৪২টি পিলারে মোট ৪১টি স্প্যান বসবে। এই সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি আর নিচ দিয়ে ট্রেন চলার কথা রয়েছে। ব্যাপক বিতর্ক আর আলোচনায় কয়েক বছরের বিলম্বের পর ২০১৪ সালে এই সেতুর নির্মাণকাজ নিজস্ব অর্থে সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। সর্বশেষ সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন সেতুটি ২০২১ সালের জুন নাগাদ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

মেট্রোরেল : ২০২০ সালের প্রথম দিনে ঢাকার দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও রেল ট্র্যাক বসানোর কাজের সূচনা করেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, এমআরটি লাইন ৬ যেটি উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের সাড়ে আট কিলোমিটার সেটি এখন দৃশ্যমান। আশা করছি এটিতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ যাত্রী চলাচল শুরু করবে। মন্ত্রী বলেন, এ প্রকল্পের ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মোট ১৬টি স্টেশন হবে এবং মেট্রোরেল ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহণ করতে পারবে। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পে মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার কোটি টাকা।

পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ: পদ্মা সেতু রেল সংযোগটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কথা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী মাওয়াতে পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এর পর থেকে কাজ এগিয়েছে ধীরগতিতেই। চীনের সাথে চুক্তিতে বিলম্ব, নকশা নিয়ে সমস্যা, ঠিকাদারের সাথে সময়মতো চুক্তি না হওয়ায় এ প্রকল্প প্রত্যাশামতো এগোয়নি। তবে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানান, মোট ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ যশোর পর্যন্ত। যদিও তাদের অগ্রাধিকার হলো মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত। বাকি রেলপথ করা আছে। তিনি বলেন, পুরো প্রকল্পের জন্য আমাদের ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময় দেয়া আছে। তবে পদ্মা সেতুর অগ্রগতির সাথে সাথে রেলের কাজও চলছে। ভাঙ্গা থেকে মাওয়া ২৬ কিলোমিটার নতুন এলাইনমেন্ট ধরে কাজ চলছে। আশা করি যেদিন পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলবে, সেদিন থেকে ট্রেনও চলবে।

দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল : রেলমন্ত্রী বলছেন, বনের জায়গা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কারণে সরকারের এই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরুতে বিলম্ব হলেও ইতোমধ্যেই এর ৩০-৩৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। এখন সমস্যা কেটে গেছে এবং কাজও পুরোদমে চলছে। আশা করি নির্ধারিত ২০২২ সালের মধ্যেই এ প্রকল্পটি আমরা সম্পন্ন করতে পারব।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পাবনার রূপপুরে দুই হাজার চারশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে রাশিয়ার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল সাত বছর ধরা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালের অক্টোবরে উৎপাদনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। কর্মকর্তারা আশা করছেন নির্ধারিত সময়েই প্রকল্পটি সম্পন্ন হবে। যদিও এ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি টারবাইন হলের ভিত্তি নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে গত আগস্টেই। এক লাখ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে পাবনার রূপপুরে, যেখানে দুটি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট করে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র: বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যাশা, সব বাধা মিটিয়ে ২০২১ সালের শেষ দিকেই রামপাল থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আসতে শুরু করবে। তবে শুরু থেকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে বিতর্ক চলছে। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কারণে রামপাল প্রকল্প পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং নিকটবর্তী সুন্দরবনে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনবে- এই যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে পরিবেশবাদী বহু সংগঠনই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করছে। তবে সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। মোংলা-খুলনা মহাসড়কের পাশে রামপালে প্রায় ১৮৩৪ একর জমির ওপর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ করছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং এতে ব্যয় হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ: মাতারবাড়ি ও ঢালঘাটা ইউনিয়নের এক হাজার ৪১৪ একর জমিতে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে। কর্মকর্তারা বলছেন, এর কাজও এগিয়ে চলছে। ২০২৩ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ : মহেশখালীর কাছে বঙ্গোপসাগরে যা ভেসে আছে, সেটির নাম হচ্ছে 'ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট' (এফএসআরইউ)। বিশাল এই জাহাজ-কাম-টার্মিনালটি কাতার থেকে নিয়ে এসেছিল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি। সেই তরল জ্বালানিকে আবার গ্যাসে রূপান্তরিত করে এটি ৯০ কিলোমিটার পাইপ লাইন দিয়ে তা পাঠায় চট্টগ্রামে। এই ভাসমান টার্মিনালটি মহেশখালীতে এসে পৌঁছায় ২০১৮ সালের এপ্রিলে।

পায়রা বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প : প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিন বিবিসিকে জানান প্রথম ইউনিটে ৬৬০ মেগাওয়াটের নির্মাণকাজ শেষ। আর দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শেষে আগামী মে মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। তবে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য সরবরাহ লাইন তৈরির কাজ এখনো শেষ হয়নি।

পায়রা বন্দর: বন্দরটির কার্যক্রম মোটামুটি মাত্রায় শুরু হয়েছে। পায়রা থেকে ঢাকামুখী যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের কাজও চলছে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৩ সালের মধ্যে ১৬ মিটার গভীরতায় চ্যানেল ড্রেজিং সম্পন্ন করে পূর্ণাঙ্গ বন্দর সুবিধা গড়ে তোলা। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাতে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে ১ হাজার ১২৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে তা শেষ হওয়ার কথা ছিল। ব্যয় প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা ও সময় আরো দুই বছর বাড়ানো হয়। আগামী ৩৪ মাসে তা শেষ হবে বলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করছেন।

সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর : এর অগ্রগতি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা শেষ করেছে জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল (পিসিআই)। প্রাথমিকভাবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) ভিত্তিতে নির্মাণ করার কথা থাকলেও এখন গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জিটুজি) পদ্ধতিতে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

http://dailysangram.info/post/403848