১৫ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ২:১০

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে চিঠি ইস্যুর জের

দিনভর বিক্ষোভে অচল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস

মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য খালাসের সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সংক্রান্ত চিঠিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কাজ বন্ধ করে দিয়ে দিনভর বিক্ষোভ করেছে সিঅ্যান্ডএফ মালিক ও কর্মচারউরা।

মঙ্গলবার সকাল থেকে কাজ বন্ধ করে কাস্টম হাউসের সামনে বিক্ষোভের কারণে সারাদিন কাস্টম হাউসে আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত কোনো ধরনের ডকুমেন্ট নিষ্পত্তি হয়নি।

কার্যত সারাদিন অচল ছিল দেশের প্রধান রাজস্ব আহরণকারী এই প্রতিষ্ঠানটি। এতে সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতির পাশাপাশি আমদানিকারকদেরও পণ্য ছাড় না পেয়ে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মালিক ও কর্মচারীরা বলছেন, এই বিক্ষোভ ছিল কাস্টমসের অনিয়ম-দুর্নীতি ও হয়রানির বিরুদ্ধে। এসব বন্ধে তারা ৮ দফা দাবি দিয়েছিলেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত মালিক-কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। বৈঠক শেষে ইস্যু করা চিঠি পর্যালোচনা সাপেক্ষে প্রত্যাহার ও দাবি আদায়ের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে সন্ধ্যা ৬টা থেকে তারা কাজ শুরু করে। এরপর কাস্টম হাউস সচল হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম গত ১২ জানুয়ারি ৬টি প্রস্তাব দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কাস্টমস নীতি ও আইসিটি) বরাবর একটি চিঠি প্রেরণ করেন। ‘মিথ্যা ঘোষণায় আমদানিকৃত পণ্য খালাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ’ শীর্ষক চিঠিতে বলা হয়, মিথ্যা ঘোষণায় বা ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানির বিষয় ধরা পড়লে বা প্রমাণ হলে দি কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯ অনুযায়ী জরিমানা আরোপ, তা আদায়পূর্বক পণ্যচালান খালাস প্রদান এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে লাইসেন্সিং রুলের আওতায় ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ ধরনের ঘটনায় কেবল আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ ধরনের চালান আমদানি ও ছাড়ের ক্ষেত্রে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অনেক সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এ কারণে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির প্রবণতা আশানুরূপ কমছে না। কেবল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস নয়, দেশের সব শুল্ক স্টেশনে একই অবস্থা।

জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হলে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনি রাজস্ব সুরক্ষা নিশ্চিত ও পণ্য চালান খালাস দ্রুততর হবে।

কাস্টমস কমিশনার প্রদত্ত ৬টি প্রস্তাবের শেষ প্রস্তাবে বলা হয়, কাস্টম অ্যাক্ট ও কাস্টমস এজেন্ট লাইসেন্সিং বিধিমালা ২০১৬ অনুযায়ী জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এক বছরে একাধিকবার একই অপরাধ করলে তার লাইসেন্স চূড়ান্তভাবে বাতিল করার বিধান প্রয়োজন।

বিধিমালা সংশোধন করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয় এনবিআরের কাছে। সূত্র জানায়, মূলত এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে চিটাগং কাস্টমস ক্লিয়ারিং ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন এবং চিটাগং কাস্টমস ক্লিয়ারিং ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) কর্মচারি ইউনিয়ন।

পণ্য ছাড়ের সঙ্গে জড়িত মালিক-কর্মচারীদের দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে ৮ দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। প্রথম দফা দাবিতে লাইসেন্স বাতিল সংক্রান্ত কাস্টম হাউসের ইস্যু করা চিঠি প্রত্যাহারের শর্ত দেয়।

এই চিঠিকে তারা অপমানজনক উল্লেখ করে এতে বলা হয়, একই ধরনের পণ্যের শুল্ক দেশের অন্য কাস্টম হাউসের তুলনায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বেশি আদায় করা হচ্ছে। ডাটাবেজ না মেনে অনেক ক্ষেত্রে ‘লোড’ বা অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হলেও তা না দেখে ইচ্ছেমাফিক শুল্ক চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা সবসময় লঙ্ঘন করা হয়।

অতিরিক্ত শুল্ক দিতে গিয়ে শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এইচএস কোডের ভুল ব্যাখ্যা ও দোহাই দিয়ে আমদানি পণ্যের ওপর প্রতিনিয়ত জরিমানা আরোপ, ল্যাব টেস্টের নামে হয়রানি, একই চালানে পদে পদে কোয়ারি দিয়ে সময়ক্ষেপণ, এআইআর শাখা কর্তৃক পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষা বা পুনঃনিরীক্ষণের নামে হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ তোলা হয় দাবিতে।

এসব বন্ধের লক্ষ্যেই কাস্টম হাউসে মঙ্গলবার কাজ বন্ধ করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয় বলে জানায় দুই সংগঠন।

এ প্রসঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু যুগান্তরকে বলেন, কাস্টম হাউসে আমরা এমনিতে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছি। তার ওপর আমাদের লাইসেন্স বাতিলের জন্য নির্দেশনা চেয়ে যে চিঠি দেয়া হয়েছে সেটি অপমানজনক। তাই ওই চিঠি প্রত্যাহারসহ হয়রানি-অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে ৮ দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছি।

সিঅ্যান্ডএফ কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ৮ দফা দাবি নিয়ে কাস্টম কমিশনারের সঙ্গে নেতাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে চিঠি প্রত্যাহারসহ দাবি আদায়ের আশ্বাস দেয়ায় অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহার করে সন্ধ্যা ৬টা থেকে কাজে যোগ দিয়েছি।

চিঠি প্রসঙ্গে কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সরকারের রাজস্ব সুরক্ষা করাই হচ্ছে আমার কাজ। কোনো সৎ আমদানিকারক বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়নি। তা ছাড়া যে চিঠিটি আমি এনবিআরে পাঠিয়েছি তাতে দেশের সব শুল্ক স্টেশনে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

কোনো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স বাতিল করা হয়নি। তাহলে কেন কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ করতে হবে। তা ছাড়া আমি তো তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সবসময় আলোচনা করছি। তাদের নিয়েই তো আমার কাজ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/267074/