৪ জানুয়ারি ২০২০, শনিবার, ১২:৩২

সিটি নির্বাচনের শুরুতেই ভীতিকর পরিস্থিতি

সবেমাত্র ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়েছে। প্রচারণা শুরু হতে এখনো বেশ কয়টা দিন বাকি। এরই মধ্যে নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমনটি একটা ভীতিকর পরিবেশও তৈরি হচ্ছে। বিএনপি অভিযোগ করছে, সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন্ বাহিনী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি তারা বিরোধী প্রার্থীদের গ্রেফতারও করছে। এছাড়া নেতাকর্মীদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে হুমকি ও তল্লাশী চালাচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। সরকারি বাহিনী নেতাকর্মীদের এলাকা ছাড়ার হুমকি দিচ্ছে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। বিএনপি বলেছে, নির্বাচনে পরাজয়ের শঙ্কা থেকে তাদের জনপ্রিয় প্রার্থীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভয়াবহ সেই কালোস্মৃতি এখনো জনগণ ভুলেনি। যদি সরকারি দল আবারো এমনটি করে তাহলে তাতে অবাক হবার কিছু থাকবে না। তবে তাদের আশা, যেহেতু এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন হবেনা তাই অন্তত স্থানীয় এই নির্বাচনগুলোতে জনগণকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেয়া উচিৎ।

সূত্র মতে, সিটি নির্বাচন নিয়ে হুমকি ধামকি এমনটি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হুমকির কথা জানালেন খোদ মেয়র প্রার্থী নিজেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন বলেছেন, আমাদেরকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হুমকি দেয়া হচ্ছে। সরকারি দল চায়না আমরা নির্বাচন করি। এমনকি তারা প্রথম থেকেই একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে সরকারের নির্দেশে পুলিশ বিএনপি সমর্থিত ৩২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী তাইজুদ্দিন আহমেদ তাজুকে গ্রেফতার করেছে। গতকাল শুক্রবার ইশরাক হোসেন বলেছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তার অফিস থেকে বের হওয়ার পরে আমাদের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী ও বংশাল থানা বিএনপির সভাপতি তাজউদ্দীন আহমেদ তাইজুলকে পুলিশ আটক করে প্রায় দেড় ঘন্টা একটি রেস্টুরেন্টে আটকে রাখে। পরে তাকে বংশাল থানায় নিয়ে গেলে খবর পেয়ে আমি সেখানে যাই। আমি পুলিশের কাছে আটকের কারণ জানতে চাইলে তারা পুলিশ একটি পুরানো মামলার ওয়ারেন্ট বের করে তাকে গ্রেফতার দেখানোর কথা জানায়। তিনি বলেন, আমি মনে করি একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করার লক্ষ্যে সরকারের নির্দেশে পুলিশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুরাতন মামলায় ওয়েরেন্ট তৈরি করে তাকে গ্রেফতার দেখিয়েছে।

ঢাকা সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, সরকার সিটি নির্বাচনে ঝামেলা করছে। তাজু (তাজ উদ্দিন আহমেদ তাজু) আমাদের বংশাল থানা বিএনপির সভাপতি, বলিষ্ঠ নেতা, কাউন্সিলর প্রার্থী তাকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করেছে। কেনো করেছে? এটা ভয় থেকে তারা করছে। আমাদের জনপ্রিয় প্রার্থীরা যেন ভোট না করতে পারেন সেজন্য সরকার গ্রেফতার শুরু করেছে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে আমাদের অনেক নেতা-কর্মীকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। কাউন্সিলর প্রার্থী বলেছেন, পুলিশ ভয় দেখাচ্ছে, আপনি যদি প্রার্থী হন তাহলে আপনার অসুবিধা হবে, আপনাকে গ্রেফতার করা হবে। রিজভী বলেন, আমরা বরাবর যেটা বলে এসছি, এবারো সেটা বলছি- গণতন্ত্রের ন্যূনতম স্পেস পাবো আমরা সেখানে সুযোগ আমরা নেবো। আমরা জানি এটার জন্য আরো নির্যাতন নেমে আসবে। কিন্তু এই সুযোগটি আমরা গ্রহন করবো কারণ নাতসী দুঃশাসনে তারা তো একতরফা নির্বাচন করতে চায়। আবার বিশ্বকে একটু দেখানো আমরা একটু গণতন্ত্র গণতন্ত্র পাচ্ছি। গণতন্ত্র একটা প্রশাধনী মুখে মাখার জন্য এই নির্বাচন করে। কিন্তু নির্বাচনটা হচ্ছে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী নির্বাচন।

ঢাকা সিটি নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা একটা উৎসব মুখর নির্বাচন দেখতে চাই। কিন্তু প্রার্থীরা যে অভিযোগ শুরু থেকে করছেন তাতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। অতীতেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অরাজকতা হয়েছে। গাজীপুরের নির্বাচন প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সেখানেও যে রকম নির্বাচন হবার কথা ছিল সেরকই হয়েছে। এর থেকে বেশী কি আমরা আশা করেছিলাম? তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত এ ধরণের নির্বাচনের কোনো চ্যালেঞ্জ হবেনা ততদিন এভাবেই চলবে। শুধু মুখে মুখে অনিয়মের কথা বললে হবে না। বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, নির্বাচনে কি হচ্ছে সেটি সবাই দেখছে। তাদেরকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাবির সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বারবার বলছি এই সরকারের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করাটা বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। এরা কখনোই নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে দিবেনা। তিনি বলেন, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। ভোটাধিকার ফিরে পাবার জন্য রাজপথে নেমে আসতে হবে। তাহলেই ভোট ডাকাতি বন্ধ হবে। না হলে এরা কেন্দ্র দখল করেই যাবে। কেউই তাদের বাধা দিতে পারবেনা। এদের রুখে দেয়ার শক্তি কেবলই জনগণ। তাই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়েও আমরা সেভাবে আশাবাদী হতে পারছিনা। কারণ প্রচারণার আগেই ধরপাকড়, হুমকি ধামকি শুরু হয়েছে। আগামীতে কি হবে সেটি বুঝাই যাচ্ছে।

নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে সিটি নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারপরও নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। আমরা মনে করি প্রচারণা শুরু হবার আগেই সরকারের এমন আচরণ করা ঠিক হবেনা, যাতে করে বিরোধীরা মাঠেই নামতে না পারে। স্থানীয় সরকারের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের তুলনা করা যায় কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের কোনো তুলনা করা যায় না। এই অর্থে তুলনা করা যায় না যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন হয় না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন হয়। তবে যেহেতু অতীতে প্রায় সব কটি নির্বাচনই প্রশ্ন বিদ্ধ ছিল তাই সরকারেরই উচিৎ হবে ঢাকা সিটি নির্বাচনটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে করতে দেয়া।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির মওদুদ আহমদ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচ কে দেখছেন ‘লোক দেখানো’ হিসেবে। তিনি বলেন, ঢাকা সিটি নির্বাচন-আমি বলব, এটা একটি লোক দেখানো নির্বাচন। হৈচৈ হবে, মিছিল-টিছিল হবে, টেলিভিশনে আপনারা মিছিলও দেখবেন, সবাই শ্লোগান-টোগান দেবেন। নির্বাচনের দুই দিন আগে দেখবেন সব ঠান্ডা। তিনি বলেন, নির্বাচন যে কেমন হবে সেটি এখনই দেখা যাচ্ছে। আমাদের একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে ধরে নিয়ে গেছে। একদিকে গ্রেফতার চলছে, ভয়-ভীতি-আতঙ্ক চলছে, অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারনা চলছে। এগুলো লোক দেখানো। এই নির্বাচনকে আমি বলব, গণতন্ত্রের প্রহসন ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তারপরেও কেনো নির্বাচনে বিএনপি যাচ্ছে তা ব্যাখ্যা দিয়ে মওদুদ আহমদ বলেন, আমরা অবশ্যই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি কারণ আমরা জনগনের সমর্থিত রাজনৈতিক দল। আমরা মনে করি, যদি দেশের মানুষ ভোট দিতে পারে এই সিটি নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজিত করবে। সেটা তারা (সরকার) করতে দেবে না-এটাও আমরা জানি। সেজন্য এটা (সিটি নির্বাচন) শুধু লোক দেখানো, এটা শুধু গণতন্ত্রের যে মৃত্যু ঘটেছে বাংলাদেশে সেটা এই সরকার আবার এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করবে। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না সেটাই আবার প্রমাণিত হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রতিবাদস্বরূপ বর্জন করা হয়েছিল। এবার শেষটা দেখেই যাবো। তাবিথ আউয়াল বলেন, গতবার পরিস্থিতির কারণে আমরা নির্বাচনটি বয়কট করেছিলাম। আমরা চেষ্টা করেছিলাম একদম শেষ পর্যন্ত থাকতে। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করেছে নির্বাচন থেকে সরে আসতে। কিন্তু এবারও তারা চাইবে আমরা নির্বাচন থেকে সরে আসি। সেজন্য হামলা-মামলা, গ্রেফতার শুরু হয়েছে। এটিকে মোকাবেলা করেই আমরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবো এবং শেষটা দেখেই ছাড়বো।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি অংশগ্রহণ করার কারণেই ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি না কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। তবু আমরা জনগণের কাছে থাকার জন্য জনগণের কাছে আমাদের বক্তব্য পৌঁছানোর জন্য এবং জনগণের কাছে প্রমাণ করার জন্য যে, এই আওয়ামী লীগ ও এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনোদিন নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, জনগণ ভোট দিতে পারে না। সরকারের মন্ত্রীরা জোরগলায় বলছেন, এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। আপনারা তাদের এই কথায় আশ্বস্ত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মোশাররফ বলেন, আমার মোটেই আশ্বস্ত নই। আপনার মনে আছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দুই-দুইবার আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে যেখানে কথা দিয়েছিলেন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনে ৩০ তারিখে জনগণের হাতে না গিয়ে ২৯ তারিখ রাতে ভোট ডাকাতি করা হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী যেটা করতে পারেননি বা করেননি এখন নির্বাচন কমিশন বা মন্ত্রীরা আশ্বস্ত করলে আমরা বিশ্বাস করব না। কারণ জনগণ তাদের বিশ্বাস করে না। তিনি বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের নামে হাজার হাজার মিথ্যা মামলা। এখন সেই মামলায় হয়রানি শুরু হয়েছে।

https://www.dailysangram.com/post/402194