৩ জানুয়ারি ২০২০, শুক্রবার, ৭:০৭

ব্যাংকে চাপ বাড়ছে ঋণ অবলোপনের

প্রভিশন সংরক্ষণ না করেই অবলোপনের আবদার ; বাড়ছে ব্যাংকের মুনাফা ও ঝুঁকি

নতুন প্রজন্মের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক এক হাজার ২০০ কোটি টাকার আদায় অযোগ্য মন্দমানের খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির এমন আবদার নাকচ করে দেয়া হয়েছে। অপর একটি ইসলামী ব্যাংক প্রায় ৪০০ কোটি টাকার একই মানের খেলাপি ঋণ অবলোপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু খেলাপি ঋণ মন্দ হওয়ার সময় তিন বছরের কম হওয়ায় ওই ব্যাংকটির প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে। কিন্তু তিন বছরের বেশি হয়েছে এমন মন্দমানের বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে প্রায় তিন ডজন নতুন পুরনো সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বছর শেষে ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফায়। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

জানা গেছে, বিনিয়োগ খরা, আমদানি-রফতানি কমে যাওয়া, সুদহারে ছাড়, অনাদায়ী ঋণ বেড়ে যাওয়াসহ বিদায়ী বছরে স্বস্তিতে ছিল না বেশির ভাগ ব্যাংক। এতে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই আয়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এতে ব্যাংকগুলো ব্যয় সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করেছে। কিছু ব্যাংক ছাড়া বেশির ভাগ ব্যাংকে নতুন লোকবল নিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। আগে যে কাজ তিনজনে করতেন এখন সেই কাজ একজন দ্বারা করা হচ্ছে। অনেক ব্যাংক চাকরিতে ২০ বছরের বেশি হয়েছে এমন কর্মকর্তাদেরকে নানা কৌশলে চাকরি থেকে ছাঁটাই করছে। ব্যাংকগুলোর এমন অবস্থায় যেখানে পরিচালন মুনাফা কমে যাওয়ার কথা, সেখানে উল্টো বেশির ভাগ ব্যাংকেরই পরিচালন মুনাফা বেড়ে গেছে।

ব্যাংকগুলোর মুনাফা স্ফীত হওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, যে কয়েকটি কারণে ব্যাংকগুলোর মুনাফা স্ফীত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো খেলাপিঋণ অধিক হারে অবলোপন করা। বছরের শেষ সময়ে এসে ব্যাংকগুলো ব্যাপক ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে। কোনো ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা থেকে হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অবলোপন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী আগে কোনো মন্দমানের খেলাপি ঋণ পাঁচ বছর হলে ওই ঋণ শতভাগ প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে অবলোপন করা হতো। কিন্তু ব্যাংকগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তা দুই বছর কমিয়ে তিন বছর করা হয়। ঋণ অবলোপন করা হলে ওই ঋণ খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আলাদা হয়ে যায়। এতে কমে যায় খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণ কমে গেলে ব্যাংকের মুনাফায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট এক ব্যাংকার জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ব্যাংকঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রভিশন সংরক্ষণ করেন না। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় দিয়ে। কিন্তু নানা কৌশলে ঋণ অবলোপন করে খেলাপি ঋণ কমিয়ে মুনাফা স্ফীত করা হয়।

এ দিকে ঋণ অবলোপনের সময়সীমা পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করা হলেও এতেও কিছু কিছু ব্যাংক বিশেষ বিবেচনায় ১-২ বছরের মন্দমানের খেলাপি ঋণও অবলোপন করতে চাচ্ছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।

ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক অযৌক্তিকভাবে ঋণ অবলোপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে নতুন প্রজন্মের দু’টি ব্যাংক ও পুরনো কয়েকটি ব্যাংক রয়েছে। একটি ব্যাংক এক হাজার ২০০ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণ না করেই ঋণ অবলোপন করতে চাচ্ছে। আরেকটি ব্যাংক মন্দমানের খেলাপি ঋণের সময় তিন বছর না হলেও তারা প্রায় ৪০০ কোটি টাকা অবলোপন করতে চাচ্ছে। এভাবে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আসছে।

আরেকটি ব্যাংক তাদের প্রস্তাবে বলেছে, তাদের মোট খেলাপি ঋণের ৯০ শতাংশই মন্দমানের খেলাপি হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের কাছে খেলাপি ঋণ অবলোপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করার সামর্থ নেই। অবলোপন করার অনুমোদন না দিলে ব্যাংকটি নতুন কোনো বিনিয়োগ দিতে পারবে না। এতে লোকসান কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে ব্যাংকটির আবারো বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, প্রভিশন সংরক্ষণ না করে ঋণ অবলোপন করার অনুমোদন দেয়া সম্ভব নয়। এ কারণে প্রথমবারে তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/469179/