সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া যানবাহন রেকারিং না করতে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। সম্প্রতি ট্রাফিক সচেতনতামূলক পক্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন, 'যেখানে গাড়ি অচল, গাড়ি রেখে চালক বা মালিক কোথাও চলে গেছেন, দীর্ঘ সময় খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না; সে ক্ষেত্রে শুধু রেকারিং করা হবে। এর বাইরে কোনো গাড়ি রেকারিং করা হবে না।'
রেকারিং নিয়ে ডিএমপি কমিশনারের এমন কঠোর মনোভাবের পরও ঢাকায় উপযুক্ত কারণ ছাড়াই যখন-তখন গাড়ি রেকারিং চলছে। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রেকারিংয়ের অদ্ভুত কারণ চোখে পড়েছে। আবার কোথাও কোথাও বিল নেওয়া হলেও গাড়ি রেকার করা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেকার বিলের ভয় দেখিয়ে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা টাকা আদায় করে থাকেন। এ কারণে রেকারের কথা শুনলেই কোনো বাসচালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তারা পুলিশের সঙ্গে ঝামেলায় না গিয়ে রেকার বিল দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন।
এমনকি এমনও হয় যে, মাঝপথে হঠাৎ ভালো গাড়ি রেকারিংয়ের কারণে দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। এভাবে ভোগান্তিতে পড়ছেন পরিবহন সংশ্নিষ্টরা। সড়কে রেকারিং ঘিরে এমন নৈরাজ্য স্থায়ীভাবে বন্ধের দাবি জানিয়েছেন পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও বিশেষজ্ঞরা। কারণ নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া গাড়ি রেকারিং করা হলে তার নেতিবাচক প্রভাব যানবাহনের চালক ও হেলপারের মধ্যে পড়ে। তাদের মেজাজ খিটমিটে থাকে। এতে রাস্তায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে।
জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া গাড়ি রেকারিং না করতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক সমকালকে বলেন, সুনির্দিষ্ট কারণে বিশ্বব্যাপী রেকারিং প্রথা চালু রয়েছে। তবে আমাদের এখানে রেকারিং সিস্টেমের অপব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক সময় রেকিংয়ের কথা বলেও শেষ পর্যন্ত রেকারিং না করেই বিল নেওয়া হয়। পুলিশ রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে আইন প্রয়োগ করে। এ কাজে পুলিশ অন্যায় কিছু করলে তা সিসিটিভির সার্ভিলেন্সের মাধ্যমে শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সিসিটিভি দিয়ে শুধু অন্যের ভুল ধরলে হবে না; পুলিশকে নিজেদের ভুলও ধরতে হবে।
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ঢাকার সড়ক বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে সবাই প্রথমেই পুলিশের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলে। রাস্তায় শুধু জরিমানা আদায় করা ট্রাফিক পুলিশের লক্ষ্য নয়। এক সময় মাসে মামলা করার টার্গেট দেওয়া থাকত। বর্তমানে সেই ধরনের টার্গেট দেওয়া নেই। ঢাকা মহানগরীতে প্রতি মাসে ৬-৭ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
ঢাকায় বিকল্প পরিবহনের তিন গাড়ির মালিক ফজলুল হক জানান, ডিসেম্বর মাসেই তার গাড়ি পাঁচবার রেকারিং করা হয়েছে। এমনকি গেট খোলা রাখা, নির্দিষ্ট জায়গায় পার্কিং না করা ও ওভারটেক করলেও রেকারিং বিল আদায় করা হয়।
ফজলুল হক জানান, যেনতেন কারণে রেকারিং বিল আদায় করায় মালিকদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। আসলে রেকারিংয়ের নামে এক ধরনের বাণিজ্য হচ্ছে। একবার রেকারিং করলেও ২০০০-২২০০ টাকা দিতে হয়।
যেভাবে হচ্ছে রেকারিং :সরেজমিন দেখা যায়, ১৯ ডিসেম্বর সকালে শনির আখড়ায় আরপি এলিগেন্স পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৬৬১৯) থামিয়ে ট্রাফিক পুলিশ চালকের কাছে গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চান। কাগজপত্র দেখাতে দেরি হওয়ায় এক হাজার টাকা রেকার বিল করা হয়। অথচ গাড়ি রেকারিং করা হয়নি। বাসটির কন্ডাক্টর ইসমাইল হোসেন জানান, তাদের এ গাড়িটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করে। সেদিন সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে যাত্রী নিয়ে নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছিল বাসটি। শনির আখড়ায় ট্রাফিক পুলিশ গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চায় চালকের কাছে। কাগজপত্র সঠিক আছে। সেগুলো বের করতে দেরি হওয়ায় এক হাজার টাকা রেকার বিল করে পুলিশ।
গত ২৩ নভেম্বর জেরিন পরিবহনের একটি বাস নারায়ণগঞ্জ থেকে যাত্রী নিয়ে সায়েদাবাদে গেলে সেটি থামান কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট। চালকের কাছে গাড়ির (সিরাজগঞ্জ মেট্রো-ব-১১-০০২৭) কাগজপত্র দেখতে চান তিনি। রুট পারমিট না থাকায় বাসটিকে ১২০০ টাকা রেকারিং বিল করা হয়। বাসটির চালক মাহিন সমকালকে বলেন, 'সার্জেন্ট গাড়ি রেকারিং করেননি, তবে রেকার বিল নিয়েছেন। কী আর করার আছে!'
গত ২২ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে শনির আখড়ার দিকে যাচ্ছিলেন চালক শামছুদ্দিন। কাজলা পেট্রোল পাম্পের কাছে ট্রাফিক পুলিশ রিকশাটি আটকায়। অবৈধভাবে সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানোর অপরাধে সেটি ডাম্পিংয়ে পাঠানোর হুমকি দেয় পুলিশ। ডাম্পিংয়ে না পাঠাতে চালক কাকুতিমিনতি করতে থাকেন। একপর্যায়ে ট্রাফিক কনস্টেবল হারুন ও শরিফ ১২০০ টাকা রেকার বিল করে রিকশাটি ছেড়ে দেন।
কনস্টেবল হারুন ও শরিফ জানান, দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চারটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও তিনটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে রেকার বিল করা হয়। ওই এলাকা ট্রাফিক ডেমরা জোনের আওতাধীন।
২৬ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মগবাজার মিজান টাওয়ারের সামনে সড়কের পাশে থামানো ছিল পানি বহনকরা একটি ভ্যান। দোকানে পানি সরবরাহ করছিলেন চালক মোহন। এ সময় ট্রাফিক পুলিশ তার ভ্যানটি আটক করে এবং তাকেসহ ভ্যানটি মগবাজার মোড়ে নিয়ে যায়। মোহন বলেন, তিনি নিজেই ভ্যান চালিয়ে নিয়ে যান মগবাজার মোড়ে। গাড়ি রাস্তার পাশে রাখায় প্রথমে ১২০০ টাকা রেকার বিল করতে চেয়েছিল। বহু অনুরোধ করার পর ৬০০ টাকা রেকার বিল করে ছেড়ে দেয়।
সেদিনই সেগুনবাগিচার ব্যাটারি গলিতেও একাধিক প্রাইভেটকার, জিপ ও মাইক্রোবাস থেকে রেকার বিল আদায় করতে দেখা যায়। সার্জেন্ট হাসিবুল ও সার্জেন্ট সাব্বির রেকার বিল করছিলেন। সঙ্গে ট্রাফিকের আরও কয়েকজন সদস্যও ছিলেন। জিপটির চালক আজগর হোসেন জানান, তার গাড়িটি রাস্তার পাশে পার্ক করা ছিল। এ কারণে ১২০০ টাকা বিল আদায় করেছে পুলিশ। সার্জেন্ট হাসিবুল বলেন, 'রাস্তায় ভুল পার্কিংয়ের জন্য আইন মেনেই জরিমানা করা হচ্ছে।'
বাস ও অন্যান্য যানবাহনের অন্তত ২০ জন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গাড়ির কাগজপত্রে ত্রুটি কিংবা রাস্তায় চলাচলের সময় আইন ভঙ্গ করলে অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে রেকার বিল আদায় করে পুলিশ। রেকার বিল নগদ পরিশোধ করা হয়। এক্ষেত্রে তাদের বিলের স্লিপ দেয় পুলিশ।
তবে রেকার বিল করার ভয় দেখিয়ে ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে টাকা নেওয়ার অভিযোগও করেন একাধিক চালক। তারা বলেন, গাড়ি ডাম্পিং বা রেকার বিল করার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছে টাকা দাবি করে ট্রাফিক পুলিশ। এক্ষেত্রে ট্রাফিক সার্জেন্ট সরাসরি চালকের সঙ্গে কথা বলেন না। ট্রাফিক কনস্টেবল চালকদের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, 'রেকার বিল করতে যে পরিমাণ টাকা দিতে হবে, তার অর্ধেক টাকা দিলেই বিল ছাড়া গাড়ি ছেড়ে দেবে।' এ অবস্থায় অসহায় চালকও টাকা দেয় পুলিশকে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ সমকালকে বলেন, রেকারিং নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অরাজকতা চলছে। এটা নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। আমরা বলেছি যাতে সচল গাড়ি রেকারিং করা না হয়। এমনও নজির আছে, একই দিন একই গাড়ি দু'বারও রেকারিং করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই ছাড়া রেকারিং না করতে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা থাকলেও মাঠপর্যায়ে তার প্রতিফলন দেখা যায় না।