৩০ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১০:৪৩

পেঁয়াজের ঝাঁজে দিশেহারা ভোক্তা

খুচরা বাজারে ২৪০ টাকা, পেঁয়াজ পাতা ১০০ টাকা কেজি

পেঁয়াজের ঝাঁজ কিছুতেই কমছে না। শুক্রবার রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ২৩০-২৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৪ দিন ধরে একই দামে পেঁয়াজ বিক্রি হওয়ায় ভোক্তারা দিশেহারা।

সিন্ডিকেটের কথা বলা হলেও সিন্ডিকেট সদস্যদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। উল্টো পেঁয়াজ বর্জনের কথা বলা হচ্ছে।

রাজধানীর পাইকারি বাজারে দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি ১৫০-২২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অপরদিকে, খুচরা বাজারে পেঁয়াজ ২০০-২৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

সম্প্রতি ভোক্তাদের উদ্দেশে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেছেন, পেঁয়াজের দাম না কমলে এর ব্যবহার বাদ দিতে হবে।

এক শ্রেণির মুনাফাখোর সিন্ডিকেট নানা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা লুটে নিচ্ছে। পেঁয়াজের বেলায়ও সিন্ডিকেট এমনই করেছে। দাম না কমালে তাদের শিক্ষা দিতে পেঁয়াজ কেনা বাদ দিতে হবে।

নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. রবিউল বলেন, আমরা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি নাকি দাম কমাবে এমন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে জিম্মি- সেটাই বুঝতে পারছি না।

একাধিক মন্ত্রণালয় বলছে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দাম বেড়েছে। তাহলে প্রশ্ন- সিন্ডিকেটের সদস্যদের বের করা হচ্ছে না কেন? প্রধানমন্ত্রী ক্যাসিনো সম্রাটদের ছাড় দেননি, কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সিন্ডিকেটদের রেহাই দিচ্ছে কেন?

তিনি বলেন, অতি তাড়াতাড়ি সিন্ডিকেটের সদস্যদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় এনে পেঁয়াজের দাম সহনীয় করতে হবে।

কারওয়ান বাজারের নিত্যপণ্য কিনতে আসা আজিজুল ইসলাম বলেন, ছোট চাকরি করি। মাস শেষে যে টাকা পাই তা দিয়ে ঘরভাড়া, সন্তানদের শিক্ষা ও খাবার কিনতেই ব্যয় হয়ে যায়।

কিছুদিন পরপর একেকটি পণ্যের দাম বাড়লে অসহায় হয়ে পড়তে হয়। তিনি বলেন, ২ মাস ধরে পেঁয়াজ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

এ জন্য পেঁয়াজ খাওয়া কমিয়েও দিয়েছি। কিন্তু পণ্যটির দাম কমাতে পারছে না সরকার। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যর্থ হয়েছে।

এর দায়ভার সরকারের কাঁধে গিয়ে পড়ছে। আর আমাদের মতো সাধারণ ভোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, পেঁয়াজের দাম কমাতে ব্যর্থ সরকার।

সরকারি উদ্যোগের পরও পেঁয়াজের সরবরাহ পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। দাম এখনও সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব হলেও ব্যবসায়ীরা সরকারকে সাহায্য করছে না। দাম বাড়িয়ে তারা ভোক্তাদের পকেট থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিং জোরদার করে পেঁয়াজের দাম ভোক্তা সহনীয় করতে হবে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, রামপুরা বাজার, নয়াবাজারের খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমার ও মিসরের পেঁয়াজ ২০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। আর পেঁয়াজ পাতা প্রতি কেজি ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পেঁয়াজের দাম কমিয়ে আনতে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। সমুদ্র বন্দরসহ আকাশপথেও পণ্যটি আনা হচ্ছে।

দেশে ৪-৫টি ফ্লাইট বুক করে পেঁয়াজ আনা হয়েছে। প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টন পেঁয়াজ দেশে আসছে।

দাম কমানোর নানা উদ্যোগ ব্যর্থ : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে আকাশচুম্বী দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। সরকারের কোনো উদ্যোগই পেঁয়াজের বাজারকে স্থিতিশীল করতে পারছে না।

বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে পেঁয়াজ বোঝাই দুটি জাহাজ ভিড়েছে। জাহাজ দুটিতে ৭৭৪ টন পেঁয়াজ রয়েছে।

পেঁয়াজ নিয়ে বৃহস্পতিবার আরও তিনটি জাহাজ বহির্নোঙরে পৌঁছেছে। এছাড়া বুধবার জাহাজ থেকে ৯০০ টন পেঁয়াজ নামানো হয়েছে। এসব পেঁয়াজ মিসর, চীন, তুরস্ক থেকে আনা হয়েছে।

এরপরও পেঁয়াজের দাম কমছে না। চট্টগ্রামে খুচরা পর্যায়ে ভালোমানের পেঁয়াজ কেজি প্রতি ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চট্টগ্রামে শীতকালীন সবজির দামও চড়া।

চট্টগ্রামে পাইকারিতে ভালোমানের পেঁয়াজ কেজি প্রতি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিয়ানমারের পেঁয়াজ কেজি প্রতি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা, মিসরের পেঁয়াজ কেজি প্রতি ১৬০, চীনা পেঁয়াজ ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ভারতীয় ভালোমানের পেঁয়াজ পাইকারি বাজারে ২০০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে।

অপরদিকে, নগরীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে খুচরা পর্যায়ে মিয়ানমারের পেঁয়াজ কেজি প্রতি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, চীনা পেঁয়াজ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় ভালোমানের পেঁয়াজ খুচরা বাজারে মিলছে না।

কোথাও পাওয়া গেলেও দাম হাঁকা হচ্ছে ২৩০ টাকার উপরে। গ্রামাঞ্চলে মুদি দোকানগুলোতে কেজি প্রতি পেঁয়াজ ২৩০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে।

খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা জানান, পেঁয়াজের সংকট থেকে দাম বাড়ছে। পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে দেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলো বিদেশ থেকে সমুদ্রপথে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়।

এর মধ্যে ৫৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি পেয়েছে এস আলম গ্রুপ।

আরও দুটি শিল্প গ্রুপ আড়াই হাজার টন করে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি পেয়েছে। এসব পেঁয়াজ দেশে পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় সরকার জরুরি ভিত্তিতে আকাশপথে উড়োজাহাজে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে।

উড়োজাহাজে এস আলম গ্রুপ প্রতিদিন ১০০ টন পেঁয়াজ আমদানি করছে।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স এমএন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আলী হোসেন খোকন যুগান্তরকে বলেন, ‘পেঁয়াজ যে পরিমাণে আমদানি করা হচ্ছে তা চাহিদার অনুপাতে যথেষ্ট নয়।

ফলে দাম কমছে না। আবার পাইকারি বাজারে আমদানি বাড়ার কিছুটা প্রভাব পড়লেও খুচরা বাজারে তেমন প্রভাব নেই। খুচরা ব্যবসায়ীরা দাম বেশি আদায় করছে।

তিনি বলেন, ‘ভারত আগের মতো পেঁয়াজ রফতানি করবে এমন ঘোষণা দিলে আর কোনো কিছুর দরকার হবে না। ১ ঘণ্টার মধ্যে পেঁয়াজের দাম আগের মতো কেজি প্রতি ৩০ টাকার নিচে চলে আসবে।’

তানোরের বাজার পেঁয়াজশূন্য : তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি জানান, রাজশাহীর তানোরের হাট-বাজার পেঁয়াজশূন্য হয়ে পড়েছে।

ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন ভোক্তারা। পৌর এলাকার গোল্লাপাড়া হাট শুক্রবার ও কালীগঞ্জ হাট মঙ্গলবার বসে। শুক্রবার গোল্লাপাড়া হাটে কেউ পেঁয়াজ কিনতে পারেননি।

গোল্লাপাড়া হাট বণিক সমিতির সভাপতি সারোয়ার জাহান বলেন, মঙ্গলবার কালীগঞ্জ হাটে ৭-৮ জন পেঁয়াজ বিক্রেতাকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জরিমানা করেন। এ কারণে ভয়ে শুক্রবার কেউ পেঁয়াজ বিক্রি করেননি।

শুধু গোল্লাপাড়া হাটে নয়, উপজেলার গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারেও খুচরা বিক্রেতারা পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন।

মোবাইল ফোনে তানোরের ইউএনও নাসরিন বানু জানান, অতি মুনাফার জন্য ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের জিম্মি করতে পারেন না।

পেঁয়াজ সিন্ডিকেট নিয়ে বণিক সমিতির সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/249763/