৯ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১:০৮

সঙ্কটের মুখে পোল্ট্রি শিল্প

লাগামহীন বাড়ছে খাবারের দাম

পোল্ট্রি ফিড (হাঁস-মুরগির খাবার) তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। গত ১ যুগে (২০০৭-২০১৮) কাঁচামালভেদে সর্বনিম্ন ২৭ শতাংশ থেকে ১১৬ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দেশের সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি শিল্প ক্রমেই সঙ্কটের মুখে পড়ছে।

উৎপাদন ব্যয় অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেলেও সে হিসেবে ডিম ও মুরগির কাক্সিক্ষত দাম পাচ্ছেন না খামারিরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের ঝুঁকিতে পড়বে। সেই সঙ্গে বিদেশিদের হাতে চলে যাবে পোল্ট্রি শিল্পের বাজার।

পোল্ট্রি ফিড তৈরির জন্য মোট ৯ ধরনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল- প্রোটিন কনসেনট্রেট, ভুট্টা, লাইম স্টোন, হুইট পলিশ, সয়াবিন মিল, রাইস ব্রান, ফিস মিল, ব্রয়লার ফিড ও লেয়ার ফিড অন্যতম। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ফিআব) কাছ থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৭ সালে এ ৯ ধরনের কাঁচামালের প্রতি কেজির দাম ছিল যথাক্রমে প্রোটিন কনসেনট্রেট ৩৯ টাকা ২৭ পয়সা, ভুট্টা ১৪ টাকা ৭৭ পয়সা, লাইম স্টোন ৫ টাকা ৫০ পয়সা, হুইট পলিশ ১৪ টাকা ৯১ পয়সা, সয়াবিন মিল ২০ টাকা ৬৮ পয়সা, রাইস ব্রান ১০ টাকা ৯ পয়সা, ফিস মিল ৩৬ টাকা, ব্রয়লার ফিড ২১ টাকা ৮ পয়সা ও লেয়ার ফিড ১৮ টাকা ৭৮ পয়সা। গত ১২ বছরের ব্যবধানে এসব কাঁচামালের প্রতি কেজিতে দাম বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৫০ টাকা, ২২ টাকা ৪৩ পয়সা, ১০ টাকা, ২৮ টাকা ২৯ পয়সা, ৪১ টাকা ৯৩ পয়সা, ২১ টাকা ৭১ পয়সা, ১৫০ টাকা, ৪৩ টাকা ৫৭ পয়সা ও ৩৭ টাকা ৭৮ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। শতকরা হিসাবে এ ৯টি কাঁচামালের দাম যথাক্রমে ২৭ থেকে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছর প্রতি কেজি ভুট্টা ১৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ২০ টাকা ৭০ পয়সা, সয়াবিন মিল ৩১ টাকা ৮৬ পয়সা থেকে ৩৮ টাকা, ডিওআরবি ১১ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে ২০ টাকা ৫০ পয়সা, রাইস পলিশ ১৩ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে ২০ টাকা ৪৮ পয়সা, কর্ন গ্রটেন মিল ৬১ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ৬৫ টাকা , মাস্টার্ড অয়েল কেক ২১ টাকা ৮৮ পয়সা থেকে ২৪ টাকা, হুইট ফ্লাওয়ার (৩২% গ্রটেন) ২৩ টাকা থেকে ২৭ টাকা। এছাড়া লাইম স্টোন (পাউডার) ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে ৯ টাকা, লবণ ১৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১৭ টাকা, পামঅয়েল ৫৩ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৬৩ টাকা, সয়াবিন অয়েল ৭৪ টাকা থেকে বেড়ে ৭৮ টাকা ৭৫ পয়সা হয়।

ফিআব-এর সভাপতি এহতেশাম বি শাহজাহান বলেন, গত ১২ বছরে পোল্ট্রি মুরগি বা ডিমের দাম সামান্য বেড়েছে। তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ২০০৭ সালে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল প্রতি কেজি ১০০ টাকা। অথচ বিগত ৪ থেকে ৫ মাসে খামার পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৮৫ থেকে ১০০ টাকায়। অথচ এসব মুরগির উৎপাদন খরচ অন্তত ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। এ সময়কালে একদিন বয়সী বাচ্চার দাম অনেক কম ছিল বলেই খরচ কম হয়েছে। যদি বাচ্চার স্বাভাবিক দর থাকত তাহলে উৎপাদন খরচ আরও ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি হতো। তিনি জানান, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে চলতি বছরের বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত ডিমের দামও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। তখন বাধ্য হয়ে ডিমপাড়া মুরগিও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল খামারিদের। মূল কথা হচ্ছে, উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে এবং বাড়ছে, কিন্তু খামারিরা ডিম ও মুরগির দাম পাচ্ছেন না। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের পোল্ট্রি শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পের বাজার চলে যাবে বিদেশিদের হাতে। তখন আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।

পোল্ট্রি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে নানান জটিলতার কারণেও এসব পণ্যের মূল্য বেশ কয়েকগুণ বেড়ে যায় বলেও অভিযোগ করেছেন এর সাথে জড়িত অনেকে। তারা বলেন, বন্দরের অব্যবস্থাপনা ও কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং অদক্ষতার কারণে আমদানিকৃত কাঁচামালের মূল্য অনেক বেড়ে যাচ্ছে।

ফিআব মহাসচিব এমডি আহসানুজ্জামান বলেন, পণ্য হ্যান্ডেলিংয়ে বন্দরের অদক্ষতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের তুলনায় প্রতি টন ভুট্টা আমদানি করতে ২০ থেকে ২৫ ডলার, অর্থাৎ ৫২ হাজার টনের একটি কনসাইনমেন্টের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৩ লাখ ডলার বা প্রায় ১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো খাদ্য সংরক্ষণাগার (ফিড সাইলো) না থাকায় আমদানি পণ্য দিনের পর দিন খোলা জায়গায় পড়ে থাকছে। এতে গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। আমদানিকৃত কাঁচামাল পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র একটি টেস্টিং ল্যাব আছে। যে পণ্য ছাড় করাতে ৭ কর্মদিবসের অধিক সময় লাগা উচিত নয়, তা ছাড় করাতে ২০ থেকে ৪২ দিন পর্যন্ত লাগছে। ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষার জন্য একাধিকবার নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং একাধিক ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে। আমদানিকৃত পণ্য দীর্ঘদিন বন্দরে আটকে থাকায় বিশাল অঙ্কের বিলম্ব মাশুল গুনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের, যার বেশির ভাগ অর্থই শিপিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে চলে যাচ্ছে। এসব কিছুই ফিডের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

দেশীয় পুঁজি এবং দেশীয় উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এ শিল্পটি দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। পোল্ট্রি ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানমুখী একটি সমৃদ্ধ শিল্প। বিশেষত আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই শিল্প নতুন বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে। শুধু সরকারের অপেক্ষায় বসে না থেকে এবং চাকরিনির্ভরশীল না হয়ে এ দেশের অনেক যুব-যুব মহিলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে সমৃদ্ধ অর্থকরী শিল্পে পরিণত করেছে পোল্ট্রি শিল্পকে। বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস, ডিম, একদিন বয়সী বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। এখানে যেসব মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত, তার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ অর্থনীতিতে, নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের বিকাশমান এ শিল্পটি। অথচ আমদানিকৃত কাঁচামালের নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে এ শিল্প হুমকির মুখে।

https://www.dailyinqilab.com/article/246838/