৮ নভেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ১২:৩২

গভর্নরের সঙ্গে এবিবির বৈঠক

খেলাপি ঋণের তথ্য গোপনের ফন্দি

খেলাপি ঋণ অন্তত ৩ বছর হিসাবে দেখানো বাধ্যতামূলক হলেও এখন দাবি সঙ্গে সঙ্গেই অবলোপনের * এটি হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের ষড়যন্ত্র -অভিমত বিশ্লেষকদের

খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত। বিভিন্ন ছাড়-সুবিধা দিয়েও টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আদায় না করেই খাতাকলমে খেলাপি ঋণ কমানোর বায়না ধরেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

বর্তমানে ব্যাংকের ব্যালান্স শিট থেকে খেলাপি ঋণ বাদ দিতে অবলোপন নীতিমালা অনুসারে কমপক্ষে ৩ বছর আদায়ের চেষ্টা করতে হয়। অর্থাৎ যে কোনো খেলাপি ঋণ অন্তত তিন বছর হিসাবে দেখাতে বাধ্য।

কিন্তু এখন ব্যাংকগুলো দাবি করেছে খেলাপি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা অবলোপন করার। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে চিঠি পেয়ে নীতিমালা শিথিল করতে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে উল্লিখিত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তবে বৈঠকে এ ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও শর্তসাপেক্ষে কিছুটা ছাড় দেয়ার আভাস দেয়া হয়েছে।

বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান ও আহমেদ জামাল, ব্যাংকিং সংস্কারবিষয়ক উপদেষ্টা এসকে সুর চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক এসএম রবিউল হাসান, আবু ফরাহ মো. নাসের, এবিবি চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, ইস্টার্ন ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখার, এনআরবি ব্যাংকের এমডি মেহমুদ হোসেনসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি বিকাল ৪টায় শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কথা বলেননি। বরং সবাই গণমাধ্যমকে এড়িয়ে গেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমডিদের চাওয়া অনুযায়ী খেলাপির খাতা মুছে অবলোপন করার সুযোগ দেয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের শামিল। এটি খেলাপি ঋণের পুরো তথ্য গোপনের ফন্দি।

যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিচ্ছেন, সেখানে কীভাবে এমন প্রস্তাব আসে? কেউ কেউ বলেন, ব্যাংকিং খাত ধ্বংসে একটি চক্র মাঠে নেমেছে।

মূলত ওই চক্রটিই একেক সময় একেক প্রস্তাব নিয়ে আসছে এবং কার্যকর করছে। এতে কাগজেকলমে খেলাপি ঋণ কমলেও বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে ব্যাংকিং খাত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়ার পরিবর্তে অবলোপন নীতিমালায় ছাড় দেয়ার বিষয়টি যুক্তিযুক্ত নয়। এতে সাময়িক ফাঁকি দিলেও আমানতকারীরা তা বুঝতে পারবে। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সংকট কমবে না বরং ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, এটা ঠিক হবে না। একবার ঋণ অবলোপন করা হলে তা আদায়ের খুব বেশি চেষ্টা করে না। আর আদায়ও হয় না।

সুতরাং ৫ বছর থেকে কমিয়ে বর্তমানে ৩ বছর চলমান, তা রাখাই ভালো। এতে চেষ্টা করে যা আদায় করা যায়। কিন্তু সময় আরও কমানো ঠিক হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, জুন পর্যন্ত হিসাবে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে কুঋণ আছে ৯৭ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। যে কোনো সময় অবলোপনের সুযোগ পেলে কুঋণের পুরো অর্থ হিসাব থেকে বাদ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো।

অর্থাৎ প্রস্তাবিত নীতিমালা কার্যকর হলে জুনের খেলাপি ঋণ দাঁড়াত মাত্র ১৪ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা। তবে আইএমএফের হিসাবে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, অবলোপন নীতিমালা শিথিল করে নভেম্বরের মধ্যে সার্কুলার করা হবে বলে জানা গেছে।

এছাড়া বৈঠকে ব্যাংকের সিকিউরিটি সার্ভিসেস, অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা সংশোধন, স্ট্যাম্প ডিউটি, ব্যাংকে শ্রম আইন প্রয়োগ, ইন্টারনাল ক্রেটিড রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) গাইডলাইন সংশোধন এবং পরিবর্তনের জন্য এবিবির পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়।

এছাড়া গৃহঋণের সীমা বাড়ানো এবং খেলাপি ঋণ ও প্রভিশনিং নীতিমালা পরিবর্তনের দাবিও জানানো হয়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কমানো এবং খেলাপি ঋণ আদায় বৃদ্ধির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, খেলাপি ঋণ কমানোর ঘোষণা দিয়েই ফেব্রুয়ারিতে সর্বপ্রথম অবলোপন নীতিমালা শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৫ বছরের পরিবর্তে মাত্র ৩ বছরের অনাদায়ী খেলাপি ঋণ হিসাব থেকে বাদ (অবলোপন) দিতে পারছে ব্যাংকগুলো।

আগে মামলা ছাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবলোপন করতে পারত; এখন ২ লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ মামলা ছাড়াই অবলোপন করতে পারছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ঋণ অবলোপনের প্রস্তাবিত নীতিমালা শর্তসাপেক্ষে বিবেচনা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আরও পর্যালোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের এমডি যুগান্তরকে বলেন, আগে নিয়ম ছিল ৫ বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে হবে। কিন্তু নতুন করে এটি করা হয়েছে ৩ বছর পর। অবলোপনের জন্য কোনো সময়সীমা থাকা উচিত নয়।

ব্যাংকগুলো চেষ্টা করে যেগুলো আদায় করতে পারে না, তা তিনটি ধাপ অতিক্রম করে চূড়ান্ত (ব্যাড/লস) খেলাপি হয়। তাই মন্দ মানের খেলাপি (বিএল) হলেই প্রভিশন রেখে অবলোপন করার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে খেলাপি ঋণ কম থাকা প্রয়োজন। এজন্য আমরা এ দাবি জানিয়েছি। এতে ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের চাপ কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংক শুনেছে। আরও যাচাই-বাছাই শেষে কিছু একটা দিতে পারে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/241529/