৬ নভেম্বর ২০১৯, বুধবার, ১:০৩

ওভারটাইমের নামে চট্টগ্রাম ওয়াসায় চলছে হরিলুট

জনপ্রতি দিনে কর্মঘণ্টা ২৯!

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় অবস্থিত শেখ হাসিনা পানি শোধনাগারে সহকারী (হেলপার) পদে কর্মরত আবু জাফর। চট্টগ্রাম ওয়াসার এই স্থায়ী কর্মচারী গত জুলাই মাসে মূল বেতন হিসেবে উত্তোলন করেছেন ১১ হাজার ৯০ টাকা। একই সময়ে ওভারটাইম (অধিকাল ভাতা) হিসেবে তুলেছেন ১৫ হাজার ৬০৩ টাকা, যা মূল বেতনের চেয়ে প্রায় ৪১ শতাংশ বেশি। ওভারটাইম হিসেবে এই পরিমাণ অর্থ পেতে তাঁকে মাত্র সাত রাতে ১৪৬ ঘণ্টা বাড়তি কাজ করতে হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি রাতে তিনি ২০ দশমিক ৮৬ ঘণ্টা কাজ করেছেন। এর বাইরে তাঁর নিয়মিত দায়িত্বের আট ঘণ্টা রয়েছে। সে হিসাবে এক দিনে নিয়মিত ও ওভারটাইম মিলে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন ২৯ ঘণ্টা।

চট্টগ্রাম ওয়াসার বুস্টার স্টেশনের ইলেকট্রিশিয়ান আলী আক্কাস গত বছরের জুলাই মাসে ওভারটাইম করেন ২০০ ঘণ্টা। সে হিসাবে মূল বেতন ১৯ হাজার ৮১০ টাকার সঙ্গে ওভারটাইম হিসেবে নেন ৩৮ হাজার ২৫১ টাকা। মূল বেতনের দ্বিগুণ ওভারটাইম পেতে তিনি জুলাই মাসের প্রতিদিনই ছুটি না কাটিয়ে নির্ধারিত কাজের অতিরিক্ত ডিউটি করেছেন! ২০১৭ সালের জুলাই মাসেও বন্ধের দিন শুক্র-শনিসহ ৩১ দিনে ২০০ ঘণ্টা ওটি করে মূল বেতনের দ্বিগুণ ওভারটাইম ভাতা তুলেছেন আক্কাস। এটা শুধু ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের জুলাই মাসের চিত্র। বাস্তবে বছরের প্রতি মাসেই কমবেশি এ হারে ওভারটাইম ভাতা তুলেছেন আক্কাস।

কোনো ব্যক্তির পক্ষে মাসের প্রতিদিন ওভারটাইম করা সম্ভব কি না তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আবার চট্টগ্রাম ওয়াসার মৌখিক নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন কর্মচারী মাসে সর্বোচ্চ ১৫০ ঘণ্টা ওভারটাইম করতে পারেন। কিন্তু আলী আক্কাসসহ একাধিক কর্মচারী সেই সীমাও অতিক্রম করেছেন নিয়মিত।

তবে আলী আক্কাস দাবি করে বলেন, ‘কর্মচারী সংকট থাকায় অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়েছে আমাকে। অনেক লম্বা সময় ধরে ওভারটাইম করেছি।’

আবু জাফর আর আলী আক্কাসের মতো গত জুলাই মাসে চট্টগ্রাম ওয়াসার ২২৯ জন কর্মচারী দৈনিক আট ঘণ্টা নিয়মিত কাজের জন্য মূল বেতন হিসেবে ৩৪ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪১ টাকার বিপরীতে অতিরিক্ত ২৩ হাজার ৯৯০ ঘণ্টা ওভারটাইম বাবদ আরো ৩৪ লাখ ৬৮ হাজার ৫৯৫ টাকা উত্তোলন করেছেন।

এ তো গেল এক মাসের ওভারটাইমের হিসাব। চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত অর্থবছরে ওভারটাইম বাবদ ওয়াসার চাকরিজীবীরা পাঁচ কোটি ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ৫৯৪ টাকা উত্তোলন করেছেন। আগের অর্থবছরে অঙ্কটা ছিল পাঁচ কোটি ১৮ লাখ ৭৪ হাজার ২৫৯ টাকা।

চট্টগ্রাম ওয়াসায় ওভারটাইম-প্রীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অনেকে মূল কাজ না করলেও ওভারটাইম করতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামেন। লোকসানের কথা বলে নিয়মবহির্ভূতভাবে ছয় মাসের ব্যবধানে ভোক্তা পর্যায়ে পানির বিল বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলেও ওভারটাইমের নামে হরিলুটকে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে নীরবে।

জনবল সংকট ও কাজের চাপ বাড়ায় ওভারটাইম করাতে হয় বলে জানান চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাকসুদুল আলম। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি শোধনাগার কিংবা পাম্প ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। শুক্র-শনিবার কিংবা সরকারি ছুটির দিনেও এসব প্রকল্প বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। স্ট্যান্ডবাই পাম্পগুলোও যেকোনো মুহূর্তে চালু করার প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে ওয়াসাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। ফলে অনেককেই ওভারটাইম করতে হয়। আর মূল ডিউটির বাইরে কে কতক্ষণ ডিউটি করবে তা নির্বাহী প্রকৌশলী রোস্টার করে দেন।’

মাকসুদুল আলম আরো বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসায় এক হাজার ৫০টি পদের বিপরীতে লোকবল আছে ৬৫০ থেকে ৭০০ জন। জনবল সংকটের মাঝেই গত কয়েক বছরে শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার, মদুনাঘাট পানি শোধনাগারের মতো প্রকল্প চালু হয়েছে। তবে লোকবল নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ শুরু হলে ওভারটাইম অনেকটাই কমে আসবে।’

চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের সদস্য কাজী মহসিন বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানে ওভারটাইম থাকতেই পারে। এ ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়ে থাকলে সেটাকে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। তদন্তপূর্বক ব্যবস্থাও নিতে হবে।’ অন্যথায় ওয়াসার আগামী বোর্ড সভায় বিষয়টি আলোচনার জন্য তোলা হবে বলে তিনি কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেন।

বন্ধ পাম্পেও ওভারটাইম

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, বাকলিয়া আর খাতুনগঞ্জ নিয়ে গঠিত মড ৩-এ ৩৮টি পাম্পের মধ্যে চালু আছে মাত্র দুটি। অন্য পাম্পগুলোর মধ্যে ছয়টি পরিত্যক্ত। বাকি পাম্পগুলো মদুনাঘাট প্রকল্প চালুর পর থেকে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। অথচ বন্ধ থাকা পাম্পগুলোতেও ওভারটাইম চলছে সমানতালে। এই পাম্পগুলোতে শতাধিক কর্মচারী কাজ করলেও ওয়াসার স্থায়ী কর্মচারী ৪৯ জন। এই ৪৯ জন জুলাই মাসের মূল বেতন উত্তোলন করেন সাত লাখ ৩৭ হাজার ৩০ টাকা। পাশাপাশি পাঁচ হাজার ৮২০ ঘণ্টা ওভারটাইম ধরে উত্তোলন করা হয়েছে আট লাখ ৪০ হাজার ৮৮৭ টাকা।

কালুরঘাট বুস্টারের একটি বন্ধ পানির পাম্পে অপারেটর হিসেবে কাজ করেন মুজিবুল হক। তিনি বলেন, ‘পাম্প বন্ধ থাকলেও ওয়াসার পরিচালকের নির্দেশে এখানে থাকতে হয় আমাদের। চুক্তি অনুযায়ী তিনজন পাম্প অপারেটর পালা করে এখানে দায়িত্ব পালন করেন। আর স্থায়ী যাঁরা তাঁরা ওভারটাইম পান।’

মড-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী রানা চৌধুরীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মূলত পাম্প অপারেটর, টেকনিশিয়ান ও ফিল্ড পর্যায়ের স্থায়ী কর্মচারীরা কাজ অনুযায়ী ওভারটাইম পান। তবে এ জন্য লগবই মেইনটেন করা হয়। কেউ চাইলেই কম বা বেশি কাজ করার সুযোগ নেই।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/11/06/835878