খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল)। সরকারি এ ব্যাংকটির প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা গিলে খেয়েছেন খেলাপিরা। এর মধ্যে শুধু শীর্ষ ২০ খেলাপি হজম করে ফেলেছেন ৩২৯ কোটি টাকা। বাকি অর্থ গেছে সংশ্লিষ্ট অন্য খেলাপিদেও পেটে। এছাড়া বর্তমানে বিডিবিএলের মোট ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে ৬০০ কোটি টাকার মন্দ ঋণ রয়েছে, যা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর বাইরে ব্যাংকটির প্রায় অর্ধেক শাখা লোকসানে। এভাবে ঋণ খেলাপি ও অবলোপনের চাপে পড়ে এক রকম অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে ব্যাংকটি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিডিবিএল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট ও চরম অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংকটিতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা গত কয়েক বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করেছেন। এসব ঋণের বেশির ভাগই এখন খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, ৫০ শতাংশ খেলাপি ঋণ থাকার অর্থই হল ব্যাংকটির অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়েছে। তিনি বলেন, সীমাহীন দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে এমনটি হয়েছে। এটা যেহেতু সরকারি ব্যাংক তাই এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার যেভাবে ব্যাংক চালাচ্ছে তাতে পুরো ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে। ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর সুপারভিশনের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু অনিয়ম করলে এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। এটা এক ধরনের কালো আইন। তিনি বলেন, কালো আইন ভাঙতে না পারলে শুধু বিডিবিএল কেন, সরকারি কোনো ব্যাংকের অনিয়ম বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সাল শেষে বিডিবিএলের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে ৩২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এমএম ভেজিটেবল অয়েল প্রডাক্টসে ৭৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, ঢাকা ট্রেডিং হাউসে ৪২ কোটি ৭ লাখ টাকা, নর্থ বেঙ্গল এগ্রো কনসার্নে ২৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, টাটকা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিতে ২৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা, নর্থ বেঙ্গল পোলট্র্রি অ্যান্ড হ্যাচারিতে ১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, গণস্বাস্থ্য গ্রামীণ টেক্সটাইল মিলসে ১৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা, টি আর স্পেশালাইজড কোল্ডস্টোরেজে ১৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, রণাঙ্গন কোল্ড স্টোরেজে ১৩ কোটি ১১ লাখ টাকা, ধানসিঁড়ি কম্পোজিটে ১৩ কোটি ২১ লাখ টাকা, ঝিনাই টেক্সে ১১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, বগুড়া মাল্টি পারপাস ইন্ডাস্ট্রিজে ১০ কোটি টাকা, দুলামিয়া কটন স্পিনিং মিলসে ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, এজেড কটন ইয়ার্নে ৮ কোটি ২১ লাখ টাকা, সোয়ান টেক্সটাইল মিলসে ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা, গাংকি চকপাউডার ইন্ডাস্ট্রিজে ৬ কোটি ৬৮ কোটি টাকা, বিএস প্লাস্টিক কোম্পানিতে ৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা, এসএসআর কেমিক্যালসে ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা, নকশা ফার্নিচার্সে ৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা, উইসচেরিয়া টেক্সটাইলসে ৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা ও স্টার ৫০ ইন্টারন্যাশনাল পাবলিকে ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এতে দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ সন্দেহজনক মানের হলেও বাকি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণের এই ঋণ মন্দ বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও বেসিক ব্যাংকের পথে হাঁটছে বিডিবিএল। এখানে নিঃসন্দেহে অদক্ষতা ছিল। থাকতে পারে অনেক অনিয়ম। তা না হলে ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতি এমন হতো না।
প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিডিবিএলে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ১ হাজার ৯৬৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এছাড়া অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অথচ এর বিপরীতে ২০১৬ সালে আদায় হয়েছে মাত্র ৩৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা। একইভাবে ২০১৫ সালেও অবলোপনকৃত ঋণ আদায় হয়েছে মাত্র ৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনজুর আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অতীতের দেয়া ঋণগুলো খেলাপি হচ্ছে। ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু অসৎ কর্মকর্তার ইশারায় এসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। এখন নিয়ম অনুযায়ী ব্যালেন্সশিট স্বচ্ছ রাখার জন্য কিছু মন্দ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। সেগুলো আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতি বছর অবলোপনকৃত কিছু কিছু ঋণ আদায়ও হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বিদায়ী বছরে বিডিবিএলের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৭২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৭৩০ কোটি ২৯ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৪৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এর থেকে ৬০২ কোটি টাকা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম, যা মোট ঋণ বিতরণের প্রায় ৪০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এসব অনিয়মে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শুধু চাকরিচ্যুত করলে হবে না। আইনের মাধ্যমে অনিয়ম করা সব অর্থও ফেরত নিতে হবে। তা না হলে হাতিয়ে নেয়া অর্থ তার কাছে থাকলে চাকরি গেলেও কোনো ক্ষতি হয় না।
বিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ থেকে ২০১৬ সালে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৩৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ সময় আদায় হয়েছে মাত্র ৯৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। একইভাবে ২০১৫ সালেও খেলাপি ঋণ আদায়ের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আগে বিডিবিএল ভালো ছিল। বিশেষ করে ২০১০ সাল পর্যন্ত খুব বেশি প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে নানা অনিয়মের কারণে ব্যাংকটির অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য এমডি-ডিএমডি পর্যায়ে সততা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। মাঝে মাঝে শোনা যায়, শাখা পর্যায়ের অনিয়ম এমডি জানেন না, বিষয়টি বিশ্বাস হয় না।
বিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২০৪ কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে মাত্র ৬২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা অর্জন করা হয়েছে, যা মূল লক্ষ্য থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে ব্যাংকটি।
জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের ঘটনায় ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। পড়তে পারে মূলধন ঘাটতিতেও। এছাড়া ব্যাংকটি কখনও ঋণের সুদ কমাতে পারবে না।
প্রসঙ্গত সরকারি দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থার সমন্বয়ে ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর বিডিবিএলের যাত্রা শুরু হয়।