১১ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ১:৫৯

‘সম্রাটের সাম্রাজ্যে’ এখনো চাঁদাবাজি

বিদেশে পালিয়েছেন এনু-রুপন!

গুলিস্তান ও কাপ্তানবাজার এলাকার বাসস্ট্যান্ড, লেগুনাস্ট্যান্ড ও ফুটপাতে চাঁদাবাজির একক নিয়ন্ত্রণ ছিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের। ক্যাসিনো-জুয়াবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি এখন কারাগারে। তার পরও তাঁর সাম্রাজ্যে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। আগের মতোই প্রতিদিন ওই সব এলাকায় বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহন ও ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে।

এদিকে গেণ্ডারিয়া থানা শাখা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পরপরই দেশের বাইরে পালিয়ে যান। আর তাঁর ভাই একই এলাকার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়াকে এলাকায়ই দেখেছেন বলে দাবি করেছেন স্থানীয় লোকজন। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, রুপনও বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

গত বুধবার দুপুরে সরেজমিন কাপ্তানবাজারে গিয়ে দেখা যায়, এক লাইনম্যান লেগুনার নম্বর লিখে রেখে চালকের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। তাঁর তালিকায় তখন পর্যন্ত অন্তত ৫০টি লেগুনার নম্বর দেখা গেছে। ওই লাইনম্যানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি তাতে রাজি হননি।

লেগুনাচালকরা বলেছেন, লাইনম্যানের নাম রিপন। সম্রাট গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এই এলাকায় যারা চাঁদাবাজি করত, তারা এখনো করছে।

এক লেগুনাচালক কালের কণ্ঠকে জানান, রিপন তাঁর কাছ থেকে ৬০০ টাকা নিয়েছেন। এই টাকা না দিলে তাঁর লেগুনাই চালানো বন্ধ করে দেবে।

আরেক লেগুনাচালক দুঃখ করে বলেন, ‘ভাবছিলাম দ্যাশে যা শুরু হইছে আর মনে অয় চান্দা দেওন লাগবো না। কিন্তু কিসের কী? প্রতিদিনই তো চান্দা দিচ্ছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকেই প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা নেয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন। কাপ্তানবাজার এলাকায় স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা চাঁদা তোলেন। চাঁদাবাজির এই টাকা যেত সম্রাটের পকেটে।

চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ারী থানার ওসি আজিজুর রহমান বুধবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাছে চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ নেই। কোনো লেগুনাচালক অভিযোগ করতে আসে না।’ তালিকা করে চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে গোপনে কাউকে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে বলুন। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন হবে।’

গত রবিবার ভোরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা যুবলীগের সভাপতি সম্রাট ও তাঁর সহযোগী এনামুল হক ওরফে আরমানকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। সেখানে মদ্যপ অবস্থায় পাওয়ায় আরমানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কুমিল্লার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সম্রাটের তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত রবিবার দুপুরে রাজধানীর কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে অভিযান চালান। বন্য প্রাণীর চামড়া রাখার দায়ে সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অস্ত্র ও মাদক রাখায় সম্রাট ও আরমানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা করা হয়। গ্রেপ্তারের পর সম্রাটকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এখনো অধরা এনু-রুপন : ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যেই গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকায় গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগ নেতা দুই ভাই এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়া, তাঁদের কর্মচারী ও তাঁদের এক বন্ধুর বাসা থেকে পাঁচ কোটি টাকা ও আট কেজি স্বর্ণালংকার উদ্ধার করে র‌্যাব। কিন্তু তাঁদের কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। পলাতক দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি ও অর্থপাচার আইনে আরেকটি মামলা করে র‌্যাব। এর মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলাটি তদন্তের জন্য ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সূত্রাপুর থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী। আর অর্থপাচার আইনের মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি।

জানতে চাইলে কাজী ওয়াজেদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মামলা পাওয়ার পর এনু ও রুপনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাওয়া যায়নি।’

গত বুধবার গেণ্ডারিয়া এলাকায় খোঁজ নিতে গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, তাঁরা শুনেছেন এনুর মতো রুপনও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও তাঁরা কিভাবে প্রশাসনের সহযোগিতা পাচ্ছেন, তা ভেবে অবাক লাগছে। যদি প্রশাসনের সহযোগিতা নাই পায় তা হলে তাঁরা কী করে বিদেশে পালিয়ে গেলেন?’

উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো-জুয়াবিরোধী অভিযানের প্রথম দিন রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। এরপর গত ২০ সেপ্টেম্বর র‌্যাব গ্রেপ্তার করে জি কে শামীমকে। তাঁরা দুজনই সম্রাটের ঘনিষ্ঠ। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তারকৃত ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্রধান গ্রুপের কর্ণধার সেলিম প্রধান ও মোহামেডান ক্লাবের কর্মকর্তা লোকমান হোসেন ভূঁইয়া কারাগারে রয়েছেন। সর্বশেষ গ্রেপ্তারের পর বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট কারা হেফাজতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/10/11/825148