২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার, ১:০৬

কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য!

নেপথ্যে প্রভাবশালী মাস্তান-বড় ভাই

‘গ্যাং কালচারের’ নামে সারা দেশে কিশোরদের একটি অংশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তারা পাড়া মহল্লার প্রভাবশালী, মাস্তান বা বড় ভাইদের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। দলবেঁধে মাদক সেবন করার পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় নারীদের উত্ত্যক্ত করে। ঝুঁকিপূর্ণ বাইক ও কার রেসিং তাদের ‘ফ্যাশন’। তুচ্ছ ঘটনায় মারামারি ও ঝগড়া ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ছে এসব কিশোর। এতে করে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। ‘ভার্চুয়াল’ জগতে ‘সিক্রেট গ্রুপ’ তৈরি করে এরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করছে। সেখানে ভয়ঙ্কর ‘সিক্রেট মিশনের’ খুঁটিনাটি বিষয়ের পরিকল্পনা করছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের রয়েছে বাহারি সব নাম। স্থানীয় বড় ভাইদের আর্শিবাদপুষ্ট এসব কিশোরদের অত্যাচারে রাজধানী, বিভাগীয়, জেলা এমনকি উপজেলার বাসিন্দারাও অতিষ্ঠ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিশোর অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা। এরই অংশ হিসেবে বিশেষ অভিযানও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে শুরু হতে না হতেই তা চাপা পড়তে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে জুয়ার আসরে পুলিশের মনোযোগ বেড়েছে। আর এ কারেণ কিশোর অপরাধ দমনে অভিযান কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। পাড়া মহল্লায় আবার কিশোর আড্ডা জমছে। সক্রিয় হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। দক্ষিণাঞ্চলের উঠতি-ছিচকে মাস্তান ও কিশোর গ্যাং গ্রুপ এখনো অনেকটাই অধরা। অথচ এসব গ্রুপ সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলেও সামাজিক স্বস্তি কেড়ে নিতে শুরু করেছে। অভিভাবকসহ পরিবারের ছোট বড় সকলেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। খুলনা ও যশোর অঞ্চলেও কমছে না কিশোর গ্যাং তৎপরতা। আমাদের সংবাদদাতাদের প্রতিবেদন অনুযায়ি যে সব এলাকায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তৎপর হয়েছে সে সব এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা অনেকটাই কমে এসেছে। রাজধানী ঢাকার চিত্রই এরকমই। র‌্যাব কিশোর গ্যাং ধরতে তৎপর হওয়ার পর মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত কিছুটা কমেছে। তবে উত্তরাসহ গুলশান, বনানী, শাজাহানপুর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলীসহ পুরান ঢাকা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা এতটুকু কমেনি। বরং কোনো কোনো এলাকায় বেড়েছে।

কয়েক দিন আগে রাজধানীর মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজের কনভেনশন হলে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের আবির্ভাব হয়েছে। এ বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনী যথেষ্ট সজাগ আছে। অভিভাবকদের অনুরোধ করব, ছেলেমেয়েরা কে কী করছে লক্ষ্য রাখুন। কিশোর গ্যাংয়ে কেউ যেন সম্পৃক্ত হতে না পারে সজাগ থাকুন। একইদিন রাজধানীর লালবাগের হোসনি দালান ইমামবাড়ায় পবিত্র আশুরা উপলক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে গিয়ে ঢাকা মহানগরের তৎকালিন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, অভিযান চালিয়ে ঢাকায় কিশোর গ্যাংসহ অন্য সব গ্যাং নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। কোনো কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকতে দেয়া হবে না। ঢাকায় কোনো গ্যাং থাকবে না। একই দিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডিএমপি কমিশনারের কঠোর হুঁশিয়ারির পর পুলিশ ও র‌্যাব অনেকটাই তৎপর হয়। কিন্তু এর কয়েকদিনের মধ্যেই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে সেই তৎপরতা ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে। তবে পুলিশ দাবি করেছে, গোপনে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা মনিটরিং করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্পটে গোপনে ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে।

কিশোর গ্যাং প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. আ ক ম জামাল উদ্দীন বলেন, কিশোরদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে যে শিক্ষার দরকার পারিবারিক ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন কারণে সেটা তারা পরিবার থেকে পাচ্ছে না। তিনি বলেন, সনাতন সমাজ থেকে শিল্প সমাজে প্রবেশ করার সাথে সাথে সামাজিক যে পরিবর্তন হয়েছে তা মোকাবেলায় আমাদের সে ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ফলে যারা একেবারেই নিম্নবিত্ত তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে লালিত পালিত হওয়ার পরিবর্তে বাইরে বা বস্তিতে বেড়ে উঠছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিশু পরিচর্যাকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। নৈতিকতার শিক্ষা যেহেতু শিশুরা পরিবার থেকে পেতে ব্যর্থ হচ্ছে তাই স্কুলের পাঠ্য বইয়ে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

প্রফেসর জামাল উদ্দীন বলেন, পশ্চিমা দেশে সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও শিক্ষা পদ্ধতিতে অনেক আগেই পরিবর্তন এনেছে আমরা তা পারিনি। এটা সরকারের একার না বরং সামাজিক সমস্যা। তাই রাষ্ট্র ও সংস্থার তত্ত্বাবধানে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনাগারে রাখার বিষয়গুলো এখন অনেক দেশে নাই। তাই সমাজ পরিবর্তনের সাথে কি চাহিদা সেটা চিহ্নিত করে সে ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।

জানা গেছে, রাজধানী যাত্রাবাড়ীর দনিয়া বর্নমালা স্কুল রোডে অনামিকা টাওয়ারের সামনে প্রতিদিন যে সব গ্রুপ আড্ডা দেয় তারা এখনও সক্রিয়। স্থানীয় বাসিন্দারা এ নিয়ে কয়েকবার যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী থানা পুলিশে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পায়নি। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, খবর পেয়ে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে কিশোরদের মারামারি করতে দেখেছে। এরপরও কিছু না বলে চলে গেছে। এতে করে কিশোর গ্যাংদের সাহস আরও বেড়ে গেছে। কয়েক দিন আগে এ ঘটনার পর তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। স্থানীয়রা জানান, বর্ণমালা স্কুল রোডে অনামিকা টাওয়ারের সামনে যারা আসে তাদের অধিকাংশ পার্শ্ববর্তি মুরাদপুর, জুরাইন, রায়েরবাগ, শ্যামপুর, ধোলাইপাড়, মীরহাজিরবাগ, পলাশপুর এলাকার। বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। মুরাদপুর থেকে আসে মামুন, সৈকত, অভি, মুন্না গ্রুপের বেশ কয়েকজন। এদের সাথে দুজন করে তরুণীও থাকে। তবে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে শিবু খুবই উচ্ছৃঙ্খল। তার সাথে আছে আরও ১০/১২জন। মোটরসাইকেল আরোহী শিবুর সহযোগিরা প্রতিদিনই হৈচৈ করে বিরোধ বাধিয়ে দেয়। প্রায় প্রতিদিনই এরা মারামারিতে লিপ্ত হয়ে এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে। একই চিত্র কদমতলী থানার আরও কয়েক স্থানেরও। প্রতিটি এলাকার সাধারণ মানুষ এসব কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে তটস্ত।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, এরা কথায় কথায় মারামারিতে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি ভাড়াটে হিসাবেও ব্যবহার হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই মাদকাসক্ত। কেউ কেউ আবার মাদকের ব্যবসার সাথেও জড়িত। প্রভাবশালীরা তাদের ফায়দা হাসিলের জন্য এদেরকে ব্যবহার করে থাকে।

এদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং উত্তরা এলাকার কোনো উন্নতি হয়নি। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নিস্ক্রিয়তায় উত্তরায় কিশোর গ্যাংরা আগের মতোই বেপরোয়াই আছে। এর মধ্যে রয়েছে, পাওয়ার বয়েজ, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার ও নাইন এমএম বয়েজ, এনএনএস, এফএইচবি, জিইউ, ক্যাকরা, ডিএইচবি, ব্ল্যাক রোজ, রনো, কেনাইন, ফিফটিন গ্যাং, ডিসকো বয়েজ, পোটলা বাবু, সুজন ফাইটার, আলতাফ জিরো, ক্যাসল বয়েজ, ভাইপার, তুফান, থ্রি গোল গ্যাং। এসব কিশোর গ্যাং এর উৎপাত দ্বন্দ্বে উত্তরা এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। বিশেষ করে বিকালে কোচিং সেন্টারগুলোতে কিশোর গ্যাং সদস্যদের উৎপাতে অবিভাবকরা তটস্ত থাকেন।

উত্তরার পরেই ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং রয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকায়। তবে র‌্যাবের অভিযানে গত বুধবার কয়েকজন কিশোরগ্যাং সদস্য গ্রেফতার হওয়ায় মোহাম্মদপুরে এদের তৎপরতা কমে এসেছে বলে ভুক্তভোগিদের দাবি।

অন্যদিকে, ঢাকার হাজারীবাগ ও গেন্ডারিয়ায় দাপিয়ে বেড়ানো ‘বাংলা’ ও ‘লাভলেট’ গ্যাং গ্রুপের তৎপরতাও থেমে নেই। সক্রিয় রয়েছে শ্যামপুর এলাকার জাহাঙ্গীর গ্রুপ। বাইক গ্রুপের দ্বীপ, সবুজ,রিদম, রাজু, খোকন, রিংকু, কদমতলীর পাটেরবাগ বাগিচার রাকিব ও তুষার গ্রুপ। এ ছাড়া আলমবাগে জুবায়ের, বাবু, কামরুল, মদিনা মসজিদের গলির সাজু, রেললাইনের আলমগীর, শ্যামপুরে ইমরান, রুমান গ্রুপের তৎপরতাও এতটুকু কমেনি। ভুক্তভোগিরা জানান, যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগের অন্তু গ্যাং,পাড় গেন্ডারিয়া পালোয়ান গ্রুপ, গেন্ডারিয়া থানার নামাপাড়ার বাপ্পি স্কোয়াড, কাঠের পুলের সবুজ গ্যাং, গেন্ডারিয়ার হীরা বাহিনী, নবীন ভাই ভাই গ্রুপ, সুত্রাপুরের কালা ফয়সাল, নারিন্দার বাবু বাহিনী আগের মতোই সক্রিয়। পুরান ঢাকার বাসিন্দারা এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামের জুয়ার আসরে পুলিশের মনোযোগ বেড়েছে। আর এ কারেণ কিশোর অপরাধ দমনে অভিযান কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। পাড়া মহল্লায় আবার কিশোর আড্ডা জমছে। সক্রিয় হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হলে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি ক্লাবে হানা দেয় র‌্যাব ও পুলিশ।

অভিযানের পাশাপাশি থানা পুলিশ জুয়ার অড্ডায়গুলোতে নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। অভিযোগ রয়েছে পুলিশের জুয়া ও ক্লাবমুখী মনোযোগের কারণে নগরীরর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর অপরাধের উৎপাত দেখা যাচ্ছে। তবে নগর পুলিশের কর্মকর্তারা এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন। উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক বলেন, কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের বিষয়টি পুলিশের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় বেশ কয়েকজন কিশোর অপরাধী গ্রেফতার হয়েছে।

রাজশাহী ব্যুরো জানায়, কিশোর গ্যাং কালচার নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণায় নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদের দমনে তৎপরতা শুরু করে। জেলা প্রশাসন এদের ধরতে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে রাস্তায় নামায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিশেষ করে ইভটিজারদের ধরতে মাইক্রেবাস নিয়ে নগরজুড়ে ঘুরে ফেরে ভ্রাম্যমান আদালত। হানাদেয় বিনোদন পার্কে। আটকও হয় বেশ কজন। প্রথমবার সতর্ক করে অভিভাবকদের ডেকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। পুলিশও তৎপর হয়। নগরীর পদ্মা নদীর তীরের বিনোদন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে টহল দেয়ায় এ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সতর্ক হয়। অবস্থান বদলায় বিনোদন স্পট ছেড়ে নগরীর আনাচে কানাচে গজিয়ে ওঠা ফাষ্টফুডের দোকান গুলোতে ভীড় জমায়। অনেক ফাষ্টফুডের দোকানে সাধারনত বিকেলে ভীড় জমতো এখন সকাল থেকে সচল।

তাছাড়া রুয়েট শিক্ষক ও তার স্ত্রীকে লাঞ্চিত করায় তরুন আসামীরা ধরা পড়ে। অভিভাবক আর আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক বড় ভাইয়েরা তাদের সতর্ক করে। ফলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ওদের তৎপরতা কমেছে। কিন্তু এরই মধ্যে নগরীর চারখুটার মোড়ে গত বৃস্পতিবার টিফিন খাবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইউসেফ মোমেনা বক্স স্কুলের অষ্টম শেণীর ছাত্র ইমন হোসেন সহপাঠিদের ছুরিকাঘাতে খুন হয়। পুলিশ এ ঘটনায় তার চার সহপাঠিকে গ্রেফতার করেছে। দুপুরে টিফিন খাওয়া নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পয্যায়ে সহপাঠি হৃদয় তার কাছে থাকা চাকু দিয়ে ইমনের পেটে আঘাত করে। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রদের কোমরে ছুরি লুকিয়ে রাখা আর তার ব্যাবহারে হতভম্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিভাবক আর সাধারণ মানুষও।

রাজশাহীর বাঘায় গত বৃস্পতিবার কিশোর গ্যাংয়ের অপহরনের শিকার হয় সুলতানপুর গ্রামের দুইভাই রহিম ও পাভেল। তারা নতুন মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি ফেলার পথে বিকেলে কালিগ্রামের কাছে পৌছামাত্র চার পাঁচ জনের একটি দল তাদের থামিয়ে পুলিশ পরিচয় দিয়ে অপহরন করে মুক্তিপন দাবী করে। পরে পুলিশ প্রান্ত (২৪) আলী হোসেন (২২) মোশারফ হোসেন নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে।

শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে কিশোর গ্যাংয়ের ডালপালা। এরা তাদের মাদকের টাকা জুটিয়ে নেয়া বান্ধবীর খরচ নিজেকে ষ্মার্ট দেখাতে পোষাক পরিচ্ছদের খরচ মেটাতে চুরি ছিনতাই অপহরনের কাজে লিপ্ত করেছে। সীমান্ত এলাকায় এসব কিশোর তরুনরা ব্যবহৃত হচ্ছে মাদক আনা নেয়ার কাজে। এক সময় তারাও মাদকাশক্ত হয়ে পড়ছে। এসব কিশোর তরুন কখনো পুলিশ র‌্যাবের হাতে ধরা পড়লেও কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবার পুরানো পথে হাটছে দ্বিগুন উৎসাহে। নগর পুলিশের খাতায় ছিনতাইকারীর তালিকায় রয়েছে বহ কিশোরের নাম। নগর পুলিশের খাতায় তালিকাভূক্তি বখাটে রয়েছে ৮১জন আর জেলা পুলিশের ৯৭ জন। কিন্তু বাস্তবে রয়েছে অনেক।

মনোবিজ্ঞানী সুশীল সমাজ বলছেন শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবেনা এদের বিরুদ্ধে সামাজিক ভাবে প্রতিরোধ গড়ার পাশপাশি প্রত্যেক পরিবারকে সচেতন হতে হবে। তাদের সন্তানরা কোথায় যায় কার সাথে মেসে তার খোজ খবর রাখতে হবে। আর কিশোরদের হাতে স্মার্টফোন দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারন এই স্মার্টফোন কালচার সর্বনাশ ঘটাচ্ছে। এরমধ্যে আশক্ত হচ্ছে পর্নোতে। ভেঙ্গে পড়ছে মানবিক মূল্যবোধ সমাজের রীতিনীতি। রাজনৈতিক বড় ভাইদের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে।

বরিশাল ব্যুরো জানায়, দক্ষিণাঞ্চলের উঠতি মাস্তান, ছিচকে মাস্তান ও কিশোর গ্যাং গ্রুপ এখনো অনেকটাই অধরা। অথচ এসব গ্রুপ সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলেও সামাজিক স্বস্তি কেড়ে নিতে শুরু করেছে। অভিভাবকসহ পরিবারের ছোট বড় সকলেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। উদ্বেগ বাড়ছে গোটা সমাজেরই। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে দৈনিক ইনকিলাবসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিষয়টি যথেষ্ট আলোচিত।

রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে পার্কসহ বিনোদন কেন্দ্র এবং অনেক পাড়া মহল্লা এখন এসব উঠতি মাস্তানদের দখলে। কিশোর গ্যাং গ্রুপগুলো একেকটি এলাকার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছে। অনেক এলাকাতেই তাদের কথার বাইরে কিছু হচ্ছে না। তবে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ বিষয়টি ওয়াকিবহাল বলে জানিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে বলেও দাবি করেছেন।

বরিশাল মহানগরীসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি জেলা উপজেলাতেই এসব উঠতি মাস্তান ও ছিচকে মাস্তান ছাড়াও কিশোর গ্যাং ইতোমধ্যে আধিপত্য বিস্তার করে নিজস্ব সংস্কৃতি চালু করেছে। এদের পেছনে তেমন কোন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয় না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মুক্ত রাজনৈতিক তৎপড়তা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি সমাজের এ দুষ্টক্ষত নির্মূলে উদাসীনতায় তা ইতোমধ্য পরিপূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করেছে। ফলে সুস্থ সমাজের জন্য এসব কিশোর গ্যাং ইতোমধ্যে নতুন দুর্ভাবনা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও তা দমনে কত দিন বা বছর অপেক্ষা করতে হবে সে বিষয়টিই এখন প্রশ্ন হয়ে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর কাছে।

বগুড়া ব্যুরো জানায়, বগুড়ায় কিশোর অপরাধি চক্র বা কিশোর গ্যাংদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা তৎপর হয়ে উঠেছে। পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা পৃথক পৃথক ভাবে বগুড়া শহরের বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, বালিকা বিদ্যালয় এর সামনে, বিভিন্ন শপিং মল এবং পার্ক গুলোতে নিয়মিত টহল জোরদার করেছে ।
এছাড়া বিকাল ৫টার পর বিভিন্ন আড্ডা স্থল গুলোতে কিশোর বয়সিদের দেখলেই আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনী তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের বাড়িতে চলে যেতে বলছে । কখনও আবার কিশোর ও তরুনদের কাছ থেকে তাদের বাবা মার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাদের মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে কথাও বলছে । ফলে শহরাঞ্চলে তরুণ ও কিশোরদের উচ্ছৃংখলতা কিছুটা কমেছে।

যশোর ব্যুরো জানায়, কমছে না যশোর অঞ্চলে কিশোর গ্যাং তৎপরতা। দৈনিক ইনকিলাবে রিপোর্ট প্রকাশের পর আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার জেলা ও উপজেলা এলাকায় কড়াকড়ি আরোপ করায় কিশোর অপরাধের মাত্রা গত কয়েকদিনে উল্লেখযোগ্যহারে লক্ষ্য করা যায়নি। তবে গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় আবারো যে কোন সময় কিশোর অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কোন কোন রাজনৈতিক নেতা ও গডফাদার কোথায় কিভাবে কিশোর অপরাধীদের নানা কৌশলে ব্যবহার করছে এবং কারা কিশোর অপরাধী এটা চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান।

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাসুদ দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, কেন্দ্রে গত ৭দিনে নতুন করে কোন কিষোর অপরাধী বন্দি আসেনি। এতে তাদের তৎপরতা কম বলেই মনে হচ্ছে। এর আগে মোট ৩শ’৫৩ জন কিশোর বন্দি রয়েছে। তার মধ্যে যশোরের রয়েছে হত্যা মামলায় ৮জন, মাদক মামলায় ৪জন, ডাকাতি মামলায় ১জন, চুরি মামলায় ১জন, নারী শিশু নির্যাতনে ২জন ও অবৈধ অনুপ্রবেশে ৩জন। জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন শিকদার জানান, আমরা সব থানা এলাকা থেকে কিশোর অপরাধীদের আপডেট তালিকা সংগ্রহ করছি।

খুলনা ব্যুরো: ‘গ্যাং কালচারের’ নামে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে কিশোররা। খুলনাঞ্চলে বাড়ছে এসব কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা। রাস্তা ঘাট, পাড়া মহল্লায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং নামের উঠতি বয়সের স্কুল পড়–য়া বখাটেরা। যাদের প্রত্যেকের বয়স আঠারো বছরের নিচে। এদের নিজ নিজ দলের রয়েছে নানা সাংকেতিক নাম। এছাড়া বিভিন্ন হত্যাকা- ছিনতাই, মাদক বেচাকেনা, অপহরণ, ঘের দখল ও ভূমিদস্যুতা সকল ক্ষেত্রে রয়েছে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহন। কিশোর অপরাধীরা অনেকেই রাজনৈতিক সেল্টারে তাদের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে।

গত বৃহস্পতিবার খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের গুপ্তির (দুই দিক ধারালো ছোরা) আঘাতে সারজিল রহমান সংগ্রাম (২৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত সংগ্রাম বাগমারা গ্রামের শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র ছেলে। তিনি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ‘ব্রাইড সি ফুডসের’ কম্পিউটার অপারেটর ছিলেন।

সম্প্রতি দৌলতপুর থানাধীন পশ্চিম সেনপাড়ার বাসিন্দা মো. মোস্তফা ফরাজীর ছেলে মো. জনি ফরাজী (১৮) কে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে কিশোর গ্যাং এর সদস্য রাব্বি, লিমন ও কালা জনিসহ অন্যরা হত্যা করে।

সম্প্রতি খুলনা পাবলিক কলেজে কনসার্ট চলাকালে সমবয়সী বন্ধুদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ফাহমিদ তানভির রাজিন নিহত হয়। রাজিন হত্যার পর গ্রেফতার হয় সাব্বির, রিফাত ও রিজভি। এদের মধ্যে রিফাত ও রিজভি ‘ডেঞ্জার বয়েজ’ গ্রুপের সদস্য। আর সাব্বির ‘গোল্ডেন বয়েজ’ গ্রুপের। ফাহিম ‘গোল্ডেন বয়েজ’ গ্রুপের অন্যতম সদস্য। হত্যাকা-ের পর র‌্যাবের হাতে আটক হয়ে রয়েল ও মিতুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানায়। পরে র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে অন্যরা।

নোয়াখালী ব্যুরো : নোয়াখালীতে জেলা শহরে মামা বাহিনীর উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের টার্গেট ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে বাইরে এলে এদের শিকার হয়। তেমনিভাবে প্রবাসী, দূর দূরন্তের বাস যাত্রীরা এদের অন্যতম টার্গেট। মাইজদী বাজার, দত্তের বাড়ি মোড়, নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল সড়ক, দত্তেরহাট বাঁধেরহাট সড়কে এদের তৎপরতা লক্ষনীয়। নোয়াখালী পৌরসভার প্যানেল মেয়র রতন কুমার জানান, গত বৃহস্পতিবার তার স্ত্রী ও ছোটভাই সীমান্ত পাল সিএনজি যোগে চৌমুহনী যাবার পথে মাইজদীবাজার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য শাওন, রায়হান, মুনিম, সাব্বির ও সজীব সিএনজির গতিরোধ করে তার স্ত্রী স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়। এসময় প্যানেল মেয়রের ভাই সীমান্ত পাল বাধা দিলে তাকে মারধর করা হয়।

মাইজদী বাজারের সাবেক এক কমিশনার জানান, এরা মামা বাহিনী নামে পরিচিত। এর আগে অপর একটি মামা বাহিনী জেলা শহরে কেনাকাটা করতে আসা এক দম্পতিকে মারধর করলে উপস্থিত জনতা এদের গণপিটুনী দিয়েং পুলিশে সোপর্দ করে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নোয়াখালী পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন জানান, কোনো সন্ত্রাসীকে ছাড় দেয়া হবেনা। সন্ত্রাসী দমনে তিনি এলাকাবাসীর সহযোগীতা কামনা করেন

https://www.dailyinqilab.com/article/237545/