২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শনিবার, ১২:৪০

অপারেশন ক্যাসিনো এরপর কী?

আদর্শলিপিতে কত কিছুই লেখা থাকে! টাকায় সম্মান মেলে না এ কথা সত্য নয়। একে দ্বিতীয় ঈশ্বরতো আর এমনি এমনি বলা হয়নি। এনুদের আপনি যতই পাতি নেতা বলুন না কেন, তারা সম্মানিত, বিশিষ্টজন। ঢাকায় যার ১৫-৩০টি বাড়ি আছে তাকে অসম্মান করবেন এমন দুঃসাহস কার? তবুও প্রশ্ন উঠছে। বলে রাখা ভালো, এদেশের সাংবাদিকতাও এখন হাওয়া দেখে চলে। কে না জানে, হাওয়ার দিকে যাওয়াইতো প্রকৃতির নিয়ম। ঢাকার সাংবাদিকতা তা ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। এদেশের মানুষ তাজ্জব বনতে ভুলে গিয়েছিল। তারা দেখে আসছেন, অনেকদিন হলো সবকিছু একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে চলছে। এবং সেটাই চলার কথা। হঠাৎ কি হলো কে জানে! ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া ছিল বড় চমক। অসাধারণ একটি সিদ্ধান্তও। যদিও তাদের এখনও আইনের মুখোমুখি করা হয়নি। মুখোমুখি করা হবে না সে কথাতো বলা হয়নি। ক্যাসিনোবিরোধী/দুর্নীতিবিরোধী/শুদ্ধি অভিযান, যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আমজনতা এ অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়েছে। তারা কিছুটা বিস্মিত এবং হতবাকও। ক্ষমতার ছাতায় থেকে টাকা কামানো, সুযোগ সুবিধা নেয়া বাংলাদেশে অভিনব কিছু নয়। সরকার বদলায়, রাষ্ট্র বদলায় কিন্তু এ রীতির কোনো বদল হয় না। তাই বলে এতটা। একটা থানা ইউনিটের সহসভাপতির ভল্টে যদি ৫ কোটি টাকা, ৭২০ ভরি স্বর্ণ মেলে তাহলে অন্য অভিযুক্তদের কী অবস্থা। ১৫ অথবা ৩০টা বাড়ির কথাও ভাবুন। কী অবিশ্বাস্য!

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ অবশ্য চলমান অভিযানকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান বলতে নারাজ। তিনি বলেন, বর্তমান যে অভিযান চলছে এটিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান বলা যাবে না। এটি ক্যাসিনোকেন্দ্রিক কিছু তৎপরতা।

শামীম, খালেদ, এনু এরাতো প্রতীক মাত্র। এবং এরা আসলে ছোট প্রতীক। ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। কিন্তু ক্যাসিনো বাদশাহ এখনো অধরা। নানা তালিকার কথা শোনা যাচ্ছে। ঢাকার একটি সহযোগী দৈনিকে খবর বেরিয়েছে ১৬৩ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। তালিকায় ৩ জন মন্ত্রী, ৩০ জন এমপির নাম রয়েছে। সে যাই হোক, এরই মধ্যে একজন এমপির ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে এনবিআর। বিশ্লেষকরা বলছেন, জিকে শামীম, এনু, খালেদদের সংখ্যা এখন অনেক। শুধু ঢাকায় নয়, জেলায়, থানায়, ইউনিয়নে, এমনকি গ্রামেও তৈরি হয়েছে বহু এনু। দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সুশাসনের হঠাৎ দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে এদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। যেমন করে শুধু রাজনীতিবিদ নয়, বালিশ, পর্দাকাণ্ডের মতো ঘটনায় জড়িত পেশাজীবীদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি। ক্যাসিনো বাদশাহরা রয়েছেন প্রতিটি জায়গায়- জিকে শামীমের কথায় যা অনেকটাই খোলাসা হয়ে যায়। তার বরাতে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা শিউরে ওঠার মতো। দুই প্রকৌশলীকেই নাকি তিনি ঘুষ দিয়েছেন ১৫০০ কোটি টাকা। এখনও পর্যন্ত ওই প্রকৌশলীদের আইনের আওতায় আনার কোনো খবর নজরে পড়েনি। অপারেশন ক্যাসিনো একদিকে তৈরি করেছে আশাবাদ। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে সংশয়। দুর্নীতির যে বিধ্বংসী বিস্তার ঘটেছে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। দেশ থেকে পাচার হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, জাতীয় আয়ের ৯৫ ভাগ চলে যাচ্ছে ৫ ভাগ মানুষের হাতে। প্রতি বছর তারা আরও ধনী হচ্ছেন। অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম কয়দিন আগে বলেছেন, ধনীদের সম্পদ বাড়ার হার বাংলাদেশে দুনিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। বছরে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকিং খাতেও ক্যাসিনোর মতো টাকা বেরিয়ে গেছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

ক্যাসিনোবিরোধী অথবা দুর্নীতিবিরোধী এ অভিযানের গন্তব্য কোথায়? এ প্রশ্ন এরই মধ্যে উচ্চারিত হচ্ছে। সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ যথার্থই বলেছেন, মূল প্রশ্নতো আসলে ক্যাসিনো নয়। মূল প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার। এখন পর্যন্ত সরকারি দলের আলোচিত নেতাদের মধ্যে মাত্র দুই জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। সবাই জানেন, এমন অপরাধীর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। এবং এটাও সরকারি দলের কেউ কেউ বলছেন, এরা দলে অনুপ্রবেশকারী।

অনুপ্রবেশকারী অথবা মূল খেলোয়াড় যা-ই হোক না কেন, দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে দুর্বৃত্তপনায় জড়িত অন্যদের কি আইনের আওতায় আনা হবে না। ডজনখানেক ক্যাসিনো সম্রাট আর উজিরের কাহিনীতো পত্রিকাতেই বের হয়েছে। জেলায় জেলায় দলের ছাতার নিচে থেকে যারা দখল রাজত্ব কায়েম করেছে, অন্যের বাড়ি দখল করে যারা ভাড়া আদায় করছেন তাদের কি আইনের আওতায় আনা হবে না। ব্যাংকিং খাতে লুটপাটে যারা জড়িত তারা কি অধরা থেকে যাবে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান অসম্ভব এক আশাবাদ তৈরি করেছে। কিন্তু তা নির্দিষ্ট গন্তব্যে না পৌঁছালে শেষ পর্যন্ত তা জাতিকে কেবল হতাশাই উপহার দিবে।

https://www.mzamin.com/article.php?mzamin=192252