২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ৪:০৬

ক্যাসিনো নিয়ে চতুর্মুখী তদন্ত

ক্লাবের নামে অসামাজিক কার্যকলাপ, ক্যাসিনো, সন্ত্রাস, ঘুষ, টেন্ডারবাজির ঘটনায় অর্জিত অর্থ ও সম্পদের উৎস জানতে চতুর্মুখী তদন্ত শুরু হয়েছে। নজর রাখা হয়েছে আলোচিত ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব, ব্যাংকের লকারে থাকা সম্পদ, তাদের প্রতিষ্ঠান ও নামে-বেনামে থাকা সম্পদ ও আয়কর নথির ওপর। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচারের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে চলমান অভিযানে বিভিন্ন নেতার বাসায় ও ব্যাংকে থাকা শত শত কোটি টাকার উৎস সম্পর্কে তদারকি করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কোটি কোটি টাকা পাচারের বিষয়ে কাজ করছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ তিন সংস্থার চাহিদামাফিক তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। একই সাথে তিন সংস্থার নির্দেশ মতো বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন ক্লাবে হানা দিয়ে ক্যাসিনোর নানা উপকরণসহ বিভিন্ন অবৈধ সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে। অপর দিকে বিভিন্ন নেতাকর্মীর বাসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে কোটি কোটি টাকা মিলছে। মিলছে কাড়ি কাড়ি বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণ। অথচ ব্যাংকিং খাতে নগদ টাকার সঙ্কট চলছে। আইনের আওতায় আসা নেতাদের আয়ের উৎস খোঁজার জন্য তাই চতুর্মুখী তদন্ত শুরু করা হয়েছে।

জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দুইভাবে এগোচ্ছে। এর একটি হলোÑ ক্যাসিনোর নামে যেসব উপকরণ পাওয়া গেছে, সেগুলো কিভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে তা দেখা হচ্ছে। অপর দিকে ব্যাংকে ও বাসায় পাওয়া কোটি কোটি নগদ টাকা ও স্বর্ণের বিষয়ে আয়করে রিটার্ন দাখিল করা হয়েছে কি না সেটি দেখা হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে আলোচিত ব্যক্তিদের নামে-বেনামে ব্যাংকে কী পরিমাণ অর্থ রয়েছে তার হিসাব বের করতে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শে প্রায় ২০ জনের বেশি ভিআইপির ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে কমপক্ষে ১২ জনের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। একই সাথে পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবৈধ কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ মিলছে ওইসব ব্যক্তির ব্যাংক লেনদেনের বিষয়ে সতর্কতা আরোপ করা হচ্ছে। সেই সাথে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হচ্ছে। ওই সব ব্যক্তিরও ব্যাংক হিসাবের তথ্য নেয়া হচ্ছে।

অন্য দিকে, ক্যাসিনো নামে যেসব উপকরণ আনা হয়েছে তা কিভাবে আমদানি করা হয়েছে সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা হয়েছে।। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এ এম ইসলাম অ্যান্ড সন্স, নিনাদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ, এথ্রি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও একটি পেপার মিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আলোচ্য ৫টি প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরো কোনো প্রতিষ্ঠান ক্যাাসিনো সরঞ্জাম আমদানির সাথে জড়িত রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।

মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, মানিলন্ডারিং হতে পারে এমন কোনো কর্মকাণ্ড হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে বা সন্দেহ হলে ব্যাংকগুলো নিজ থেকেই সতর্ক হতে পারে। আইনে ব্যাংকগুলোকে সে ক্ষমতা দেয়া আছে। ফলে চলমান অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম গণমাধ্যমে আসছে তাদের ব্যাংক হিসাবের প্রতি নজর রাখছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, এ ধরনের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য। ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয় থেকে শাখা ব্যবস্থাপকদেরকেও এ বিষয়ে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে এ ধরনের অনেক সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারছে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি একটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারা প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে সতর্ক রয়েছেন। অনেক সন্দেহভাজন ব্যক্তির নামে বড় অঙ্কের চেক আসছে। কিন্তু শাখা থেকে ওই চেকগুলো ফেরত দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছেÑ ওপরের নির্দেশে চেক নগদায়ন করা যাবে না। পরে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, অনেক ভিআইপির নাম পাওয়া যাচ্ছে। জুয়া ও ক্যাসিনোর মতো অবৈধ ও অসামাজিক কাজে যারাই লিপ্ত রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তবে, কৌশলগত কারণে অনেকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে ওই সব ব্যক্তির হিসেব খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তাদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব থেকে যেন কোনো প্রকার অর্থ উত্তোলন করতে না পারে সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, শুধু ক্যাসিনোর মতো অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িতরাই নন, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িতরাও এ তালিকায় রয়েছে।

এ বিষয়ে এর আগে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা: রাজি হাসান নয়া দিগন্তকে জানান, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে। একই সাথে বিএফআইইউ আইন অনুযায়ী সন্ত্রাসী ও মানিলন্ডারিং বিষয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে বিএফআইইউ তা অনুসন্ধান করে। সম্প্রতি এসব অপরাধে যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের হিসাবও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিএফআইইউ আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব লেনদেনে সাময়িক স্থগিতাদেশ করা যায়। প্রথমে এক মাসের জন্য; পরবর্তীতে তা সাত মাস পর্যন্ত বর্ধিত করা যায়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদালতের নির্দেশনা এনে স্থায়ীভাবে ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা থাকে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/443477/