তিন পাত্তি গোল্ড। ছবি: সংগৃহীত
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১:২৫

অনলাইনে ভয়ংকর জুয়া ‘তিন পাত্তি গোল্ড’

পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা * আসক্তদের অধিকাংশই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

ক্যাসিনোর মতোই ভয়ংকর নেশা ‘তিন পাত্তি গোল্ড’। অনলাইনভিত্তিক এই ভার্চুয়াল জুয়ায় দিন দিন আসক্ত হয়ে পড়ছেন দেশের ‘অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন’ ব্যবহারকারী সব বয়সী মানুষ।

এদের বেশিরভাগই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ভারতীয় কয়েকজন নাগরিক বিদেশে বসেই এ খেলা পরিচালনা করেন। তবে বাংলাদেশে রয়েছে তাদের কয়েক’শ ডিলার। যারা জুয়াড়িদের কাছে চিপস বা কয়েন বিক্রি করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা গেছে, রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই চলে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’। কারণ এটি খেলতে কোনো ক্লাবে যেতে হয় না। ভার্চুয়াল জুয়াটি ঘরে বসে নিজের মোবাইল ফোনে খেলছে লোকজন। আর খোয়াচ্ছে অর্থকড়ি। প্রাথমিকভাবে কম খরচ হলেও মাস শেষে খোয়া যাওয়া অর্থের পরিমাণ মোটা অঙ্কে পৌঁছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে এই জুয়ার ডিলার। তাদের কাছ থেকে বিকাশ, নগদ, রকেট কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে চিপস বা কয়েন কেনেন জুয়াড়িরা। এভাবে প্রতিবছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে দেশের কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। তবে তিন পাত্তির সঙ্গে জড়িত এবং চিপস ডিলারদের শিগগির নজরদারিতে আনা হবে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের এডিসি নাজমুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অনলাইনে জুয়া প্রতিরোধ বিষয়ে আমরা তৎপর রয়েছি। এর আগেও ক্রিকেট খেলা নিয়ে যেসব সাইটে জুয়া হতো সেগুলো আমরা বন্ধ করেছি। একটা বন্ধ করা হলে আরেকটি তারা খুলে ফেলে।

এটা নিয়মিত মনিটরিং করা দরকার, আমরা মনিটরিং করছিও। তিনি বলেন, অনলাইনে চিপস বিক্রির ডিলারদের আমরা আইনের আওতায় আনতে কাজ করছি। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করলে হবে না, পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। কারণ, যারা এ জুয়া খেলেন তারা বাসায় বসেই খেলেন।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নিহাল করিম যুগান্তরকে বলেন, ভার্চুয়াল জুয়া বন্ধ করতে হলে, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে চেয়ে থাকলে হবে না। তাতে এ অবক্ষয় থেকে মুক্তি মিলবে না।

অভিভাবক ও শিক্ষকদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বিষয়টির মন্দ দিক তুলে ধরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সন্তানদের প্রতি যেমন বাবা-মায়ের যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে শিক্ষকদেরও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিন পাত্তি গোল্ড একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ। এর মাধ্যমে চলছে ভার্চুয়াল জুয়া। প্রতিদিন ভার্চুয়াল বোর্ডে লেনদেন হয় কোটি কোটি চিপস (জুয়ার কয়েন)। বাংলাদেশে রয়েছে তিন পাত্তি গোল্ডের চিপসের কয়েকশ’ ডিলার। এরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেজ খুলে চিপস বিক্রি করছে। আর এসব টাকার একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে ভারতে।

আরও জানা গেছে, ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ একটি অ্যান্ড্রয়েড ফোনের গেম। এটি গুগল প্লে স্টোরে পাওয়া যায় অথবা গুগলে সার্চ দিলে এই গেম ডাউনলোডের জন্য অনেক সাইট চলে আসে। সোমবার পর্যন্ত এই সফটওয়্যারটি ৫০ মিলিয়নের বেশি মানুষ ডাউনলোড করেছে। এই গেমটি খেলতে হলে ইন্টারনেট কানেকশন যুক্ত অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও একটি ফেসবুক আইডির প্রয়োজন হয়।

অনলাইনে যারা চিপস কিনেছেন- এমন কয়েকজন জুয়াড়ির সঙ্গে মোবাইল ফোনে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের ফোন নম্বর চিপস বিক্রেতা ডিলারদের পেজের ‘কমেন্টবক্স’ থেকে সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু কোনো জুয়াড়িই তাদের নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। তাদের একজন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। তার বাড়ি রাজশাহী।

দু’বছর আগে এক বন্ধুর মাধ্যমে শিক্ষা নেন তিন পাত্তি গোল্ডের জুয়া। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ খেলায় প্রথম দু-একদিন জিতেছিলাম। এরপর অন্য ধরনের একটা নেশা হয়ে গেল। না খেলে থাকতে পারতাম না। লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাতের পর রাত তিন পাত্তিতেই মগ্ন থাকতাম।

তিনি আরও বলেন, এক কোটি চিপস কিনতাম ৬০ টাকা দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেরে যেতাম। আবার কিনতাম। আবার হারতাম। যতক্ষণ বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা থাকত ততক্ষণ খেলতাম। এখন লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাড়ি চলে এসেছি। এখনও খেলি। নেশাটা ছাড়তে পারি না। বাবার কাছ থেকে খরচের কথা বলে টাকা নিতাম।

এ টাকা তিন পাত্তিতে উড়িয়ে দিয়েছি। এ পর্যন্ত ৮-১০ লাখ টাকা নষ্ট করেছি। তিনি বলেন, এ খেলায় বেশিরভাগই বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী আসক্ত। এ ছাড়া অন্যান্য পেশার লোকজনও এ জুয়া খেলে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এটি তো বাসায় বসেই খেলা যায়, ক্লাবে গেলে হয়তো নানান ভয় থাকে।

তিন পাত্তির আরেক জুয়াড়ি যুগান্তরকে জানিয়েছেন, তিন পাত্তি গোল্ড হচ্ছে ৩টি তাসের খেলা। খেলার সবচেয়ে বড় কার্ড হল তিন টেক্কা আর সবনিু কার্ড ২-৩-৫। তিনি জানান, এ গেমের মূল বস্তুটি হচ্ছে চিপস বা কয়েন। ১ কোটি চিপসের মূল্যে গত ছয় মাস আগেও ছিল দেড়শ’ থেকে দু’শ টাকা। এখন ৭০-৮০ টাকায় পাওয়া যায়।

গেমের ভেতর থেকেই ডলারের মাধ্যমে কোম্পানি তাদের চিপস বিক্রি করে। কিন্তু গেম কোম্পানির কাছ থেকে ডলারের মাধ্যমে চিপস কেনা অনেকেরই সাধ্যের বাইরে। কারণ অনেক খেলোয়াড়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই এবং তারা চিপসের মূল্য অনেক বেশি নেয়।

সোমবার বিকালে সুজন ইসলাম নামের এক চিপস ডিলারের সঙ্গে ব্যবসায়ী সেজে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিন পাত্তির চিপসের রেট জানতে চাইলে তিনি ইমো নম্বরে কথা বলতে বলেন। তার ইমুতে কল দেয়ার আগেই তিনি ইমুতে একটি তালিকা পাঠান।

চিপসের মূল্য তালিকায় উল্লেখ আছে- ১ কোটি চিপস, ৭৫ টাকা, ২ কোটি ১৫০ টাকা, ৩ কোটি ২২৫ টাকা, ৪ কোটি ৩০০ টাকা, ৫ কোটি ৩৭৫ টাকা, ১০ কোটি ৭১০ টাকা, ১৪ কোটি ১ হাজার টাকা, ২০ কোটি ১৪২০ টাকা, ৩০ কোটি ২১০০ টাকা আর ৫০ কোটি ৩৫০০ টাকা।

তিনি বলেন, আমাদের কাছে ব্যাংক প্লেয়ার আইডি পাবেন। আমরা খেলে জেতা চিপস বিক্রি করি না। চিপস কেনার নিয়ম হিসেবে ইমোর মেসেজে তিনি লেখেন, ০১৮৭৭-০১৬৭৪৯ বিকাশ নম্বরে পারসোনাল বিকাশ থেকে সেন্ডমানি করবেন। দয়া করে এজেন্ট থেকে টাকা পাঠাবেন না। যে নম্বর থেকে টাকা পাঠাবেন, সেই নম্বর আর প্লেয়ার আইডির মেসেজ দিন। ২ মিনিটের মধ্যে চিপস পেয়ে যাবেন।

এরপর তার ইমু নম্বরে ফোন দিয়ে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কৌশল হিসেবে এই সেই ডিলারকে ইমোতে ফোন দিয়ে এই প্রতিবেদক বলেন, আমি তো ব্যবসা করতে চাই, এ জন্য আপনার পরামর্শ নিতে চাই। আপনি যে রেট দিয়েছেন তা তো খুচরা বিক্রেতার রেট। এতে তো আমার লাভ হবে না।

এর উত্তরে সুজন ইসলাম বলেন, আমাদের কাছ থেকে ব্যাংক নিতে পারবেন। বড় ব্যাংক নিলে আপনার লাভ হবে বেশি। আর মিনি ব্যাংকও চাইলে নিতে পারেন। আপনাকে একটি বোর্ড ও আইডি দেয়া হবে। সেটা থেকে আপনি চিপস সেল করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, বড় ব্যাংক মানে ১০০ কোটি চিপস কিনতে হবে আপনাকে।

টাকা পাঠাতে হবে বিকাশে। ১০০ কোটি চিপসের দাম সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার কাছ থেকে ৬ হাজার ২০০ টাকায় ১০০ কোটি চিপস কিনবেন। আপনি যে রেটে বিক্রি করতে পারেন আমার কোনো আপত্তি নেই। অনলাইনে সার্চ দিলে আপনি শত শত চিপস ডিলার পাবেন।

তাদের কাছ থেকেও মিনি এজেন্ট নিতে পারেন। প্রতিষ্ঠানটি ভারতীয় হওয়ায় আমরা সরাসরি ভারত থেকে চিপস নিই। তিনি তিন পাত্তি খেলার নিয়ম এবং চিপস বিক্রির নিয়ম সম্পর্কে একটি ভিডিও লিংকও পাঠান এ প্রতিবেদককে। তিনি জানান, ইউটিউব, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘিরেই এ ব্যবসা জমজমাট।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/224099/