২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার, ২:০১

ক্যাসিনোর মাধ্যমে অর্থ পাচার: বাংলাদেশেও পাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে

বিশ্বে অর্থ পাচারের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যাসিনো বা জুয়া। ইউরোপের দেশগুলোয় এক দেশের ক্যাসিনোর কয়েন সার্ভিস চার্জ দিয়ে অন্য দেশে ক্যাশ করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের ক্যাসিনোগুলো থেকে এভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নিশ্চিত করেছে।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে জুয়া খেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর মাধ্যমে সহজেই এক অ্যাকাউন্টের অর্থ অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে এটা হতে পারে। ঢাকার কিছু ক্যাসিনোতে যে কয়েনগুলো পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কয়েনের মিল আছে। এ কারণেই বিষয়টি বিশেষভাবে খতিয়ে দেয়া হচ্ছে।

এ ধরনের অপরাধের কারণে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অবস্থিত সিঙ্গাপুরভিত্তিক বেশ কয়েকটি ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে দেশটির সরকার। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) ট্রানজেশনাল ক্রাইম রিপোর্টেও জুয়ার মাধ্যমে অর্থ পাচারের কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাবের অভিযানে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো ধরা পড়ায় বিষয়টি আলোচনায় আসে।

বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে যেসব ক্যাসিনোর কয়েন পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কয়েনের মিল রয়েছে। এর মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিদেশে টাকা পাচার করার চেয়েও ক্যাসিনোর মাধ্যমে টাকা অর্জনই বড় ধরনের অপরাধ, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শাস্তিযোগ্য।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থও ফিলিপাইনে বিভিন্ন ক্যাসিনো হয়ে কয়েকটি দেশে পাচার হয়েছে। ফিলিপাইনের ক্যাসিনো পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফিলিপাইন অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড গ্যামিং কর্পোরেশন (পিএজিসি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সেখানে অন্তত ২৩টি বৈধ ক্যাসিনো রয়েছে। এর বেশির ভাগই পিএজিসি পরিচালিত। অন্য বৈধ ক্যাসিনোগুলোও ওই সংস্থাটি থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত।
চলতি বছরের শুরুতে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোগুলো চীনের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ তারা ব্যাংকিং সুবিধার অপব্যবহার করে ক্যাসিনোর মাধ্যমে টাকা পাচার করছে, যা চীনের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনের লঙ্ঘন। এজন্য বেইজিংয়ে থাকা সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়েছে। এর মধ্যে রিসোর্ট এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বেইজিং কর্তৃপক্ষ।

ওয়ার্ল্ড ক্যাসিনো ডিরেক্টরি ও ইন্টান্যাশনাল গেম্বলিং ফোরামের তথ্য অনুসারে ক্যাসিনো হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার একটি নির্দিষ্ট স্থান। সহজে যাকে জুয়ার আড্ডা বা আসর বলা হয়। নির্দিষ্ট কিছু কয়েনের মাধ্যমে এটি খেলা হয়। বাংলাদেশে এটি অবৈধ হলেও বিশ্বের কিছু দেশে এর আইনি স্বীকৃতি রয়েছে। এ সংক্রান্ত নীতিমালাও রয়েছে।

সংস্থাটির তথ্যানুসারে চলতি বছরে বিশ্বের ক্যাসিনোর মোট বাজার ১৩০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের দ্বিগুণের বেশি। ওয়ার্ল্ড ক্যাসিনো ডিরেক্টরি ও ইন্টারন্যাশনাল গেম্বলিং ফোরামের তথ্যানুসারে, সাধারণত ক্যাসিনো এমনভাবে বানানো হয় যে এর সঙ্গে কিংবা পাশাপাশি ক্লাব, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, আনন্দভ্রমণ জাহাজ এবং অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ থাকে। কিছু কিছু ক্যাসিনোয় সরাসরি বিনোদন দেয়। যেমন- স্ট্যান্ড আপ কমেডি, কনসার্ট, খেলাধুলা ইত্যাদি।

ওয়ার্ল্ড ক্যাসিনো ডিরেক্টরির তথ্যানুসারে, একক দেশ হিসেবে বিশ্বে ক্যাসিনোর বাজারে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ক্যাসিনোর জন্য বিখ্যাত দেশটির শহর লাসভেগাস। এরপরেই রয়েছে চীনের ম্যাকাও। পর্যায়ক্রমে সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, জামার্নি, ফিলিপাইন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং নেপাল উল্লেখযোগ্য।
ক্যাসিনোয় বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে যে কোনো অর্থ দিয়ে জুয়া খেলা যায়। এজন্য আগ্রহী ব্যক্তিকে প্রথমেই সার্ভিস চার্জসহ নগদ অর্থ জমা দিয়ে সমপরিমাণের কয়েন বা চিপস কিনতে হবে। এটি কয়েনের মাধ্যমে খেলে। একেক রঙের ও ধরনের কয়েনের জন্য একেক রকম মূল্যমান নির্ধারিত থাকে। সাধারণত সর্বনিু বিশ ডলারের সমমানের কয়েন থেকে শুরু করে এক হাজার ডলার সমমানের কয়েন পাওয়া যায় এসব ক্যাসিনোয়।

তবে ক্ষেত্রবিশেষ দশ হাজার বা এক লাখ ডলারের বিশেষ কয়েনও দিয়ে থাকে এসব ক্যাসিনো। ওই কয়েনগুলো নির্ধারিত সার্ভিস চার্জ দিয়ে ভাঙিয়ে নেয়া যায়। আবার কেউ তা রেখে দিয়ে পরবর্তী সময়েও চার্জসহ ভাঙিয়ে নিতে পারেন। আর আন্তর্জাতিকভাবে সম্পর্কিত ক্যাসিনোগুলোর ক্ষেত্রে এক ক্যাসিনোর কয়েন অপর ক্যাসিনোতেও ভাঙানো যায়। অর্থাৎ এই কয়েনও একধরনের ব্যাংক চেকের মতোই। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের ক্যাসিনোর আন্তঃচুক্তি থাকে। এই চুক্তি অনুসারে অনলাইনেও পেমেন্ট করা যায়। আইন অনুযায়ী ক্যাসিনোতে জুয়ায় জেতা অর্থ থেকে নির্ধারিত ট্যাক্স দিলে তা বৈধ আয় বিবেচিত হয়। শুধু তা-ই নয়, উন্নত অনেক দেশেই ক্যাসিনো মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় পড়ে না। তাই পাচার করা অর্থও ক্যাসিনোতে প্রবেশের মধ্য দিয়ে বৈধতা পেতে পারে।

চিপসের বিভিন্ন মূল্যমান থাকলেও এসব ক্যাসিনোয় মিলিয়ন বা লাখ ডলারের চিপসও অসম্ভব নয়। আর ওই বাজির কয়েন হাতবদল হয়ে তা চলে যায় অন্য কারও হাতে। পরে সেই চিপসগুলোকে নগদ অর্থে রূপান্তরিত করে ট্যাক্স পরিশোধ করার মাধ্যমে বৈধ করা হয়। তবে কেউ মিলিয়ন ডলারের ক্যাসিনোর বাজির চিপস নিজের কাছে রেখে দেয় অথবা এই চিপস বাইরে সরিয়ে ফেলে সেক্ষেত্রে এটি ব্যাংক চেকের মতোই থেকে যাবে, যা পরবর্তী সময়ে ক্যাসিনোর সার্ভিস চার্জ দিয়ে ভাঙিয়ে নেয়া যায়।

জানা গেছে, পৃথিবীতে জুয়ার ইতিহাস অনেক পুরনো। সব সমাজ ও সভ্যতায়ই জুয়ার প্রচলন ছিল। ১৬৩৮ সালে ইতালিতে প্রথম ক্যাসিনো চালু হয়। তবে ১৭৭৪ সালে তা আবার বন্ধ করে দেয়া হয়। আধুনিক বিশ্বে ১৯৩১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদায় জুয়া খেলাকে আধুনিক করে ক্যাসিনো নির্মিত হয়। এরপর ১৯৭৬ সালে নিউ জার্সি ও আটলান্টা শহরে ক্যাসিনো অনুমোদন করে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/223288/