১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ৩:৪৬

মিথ্যা ঘোষণায় আসছে মানহীন চিকিৎসাসামগ্রী

রোগ নিরাময়ের বদলে উল্টো জটিলতা

মিথ্যা ঘোষণায় নামমাত্র মূল্যে মানহীন চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি করে রমরমা ব্যবসা করছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। মানহীন ওই সব সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন ওষুধের দোকান, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে। সাধারণ মানুষ এসব সামগ্রী কিনে প্রতারিত হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের পাঠানো এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য থাকার কথা জানা গেছে।

চিকিৎসা খাতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, নিম্নমানের চিকিৎসাসামগ্রী ব্যবহার করে রোগ নিরাময় হওয়া তো দূরের কথা রোগ আরো জটিল হতে পারে, এমনকি রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরে মানহীন চিকিৎসাসামগ্রীর ১১টি চালান আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

শুল্ক গোয়েন্দাদের তৈরি করা ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানহীন চিকিৎসাসামগ্রী বেশি আমদানি করা হয়েছে তাইওয়ান, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, জার্মানি থেকে। ব্যবসায়ী পরিচয়ে একাধিক ব্যক্তি আন্তর্জাতিক চক্রের সহযোগিতায় মানহীন চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি করছেন। ওই সব সামগ্রী দেশব্যাপী বিক্রিও করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে অসাধু আমদানিকারকদের ডিলার বা এজেন্ট রয়েছে। ওই এজেন্ট বা ডিলাররা বিভিন্ন ওষুধের দোকান, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে মানহীন চিকিৎসাসামগ্রী কৌশলে বিক্রি করে থাকে। তবে তারা প্রকৃত মালিকের খোঁজ জানে না। ওই ডিলার বা এজেন্টদের কাছে সময়মতো কুরিয়ার বা অন্য কোনো পরিবহনে পণ্য পৌঁছে যায়। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করে থাকে।

প্রতিবেদন মতে, ওষুধের দোকান, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেশির ভাগ সময় না জেনেই মানহীন সামগ্রী কিনে মজুদ করে রাখে। পরে সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তা বিক্রি করা হয়। তবে অনেক সময় এসব প্রতিষ্ঠানের অসাধু ব্যক্তিরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে জেনেশুনেও মানহীন পণ্য কিনে থাকে। বাজারে বিক্রি হওয়া একই জাতীয় সামগ্রীর তুলনায় কম দামে বিক্রি করা হয় মানহীন ওই সব সামগ্রী।

শুল্ক গোয়েন্দাদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানহীন চিকিৎসাসামগ্রীর মধ্যে চিকিৎসাকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন ধরনের ওষুধ আছে। ‘জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত’ বা ‘জীবন রক্ষাকারী ওষুধ’ নামে ওই সব পণ্যের চালান বাংলাদেশে আনা হয়েছে। চালানের মোড়কে এসব লেখা থাকায় পণ্য ছাড়করণে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। সাদা পোশাকে নিয়োজিত শুল্ক গোয়েন্দাদের নজরদারিতে ওই সব চালানের বেশির ভাগ আটক করা হয়েছে। তবে ওই সব সামগ্রী কারা এনেছে তা এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। মানহীন চিকিৎসাসামগ্রীর আমদানিকারক হিসেবে ব্যবসায়ী নামধারী একাধিক ব্যক্তিকে নজরে রাখা হয়েছে। সন্দেহের তালিকায় আছে একাধিক প্রতিষ্ঠানও।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা) ডা. সত্যকাম চক্রবর্তী কালের কণ্ঠকে বলেন, নিম্নমানের যেকোনো চিকিৎসাসামগ্রীই জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। কারণ নিম্নমানের উপকরণে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। আর এসব উপকরণের মাধ্যমে কোনো ভুল হয়ে গেলে চিকিৎসায়ও ভুল হবে, যার পরিণতিতে রোগীর বড় রকমের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘বন্দরে যেমন এসব বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে তেমনি আমরাও হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে মনিটরিং করে থাকি। এ ক্ষেত্রে কোথাও কোনো অনিয়ম পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে কোনো রোগী যদি কোনো রকম অনিয়ম বা ভুলের শিকার হয়, তারা আমাদের কাছে অভিযোগ করলে এসব কাজে আরো সহায়তা দেওয়া হয়।’

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা মানহীন চিকিৎসাসামগ্রীর একাধিক চালান আটক করা হয়েছে। গুণগত মানের পণ্যের মোড়কে মানহীন চিকিৎসাসামগ্রী রেখে বিক্রি করা হয়। এতে সাধারণ মানুষের পক্ষে পণ্যের মান সম্পর্কে বোঝার উপায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে শুল্ক গোয়েন্দারা নজরদারি বাড়িয়েছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘অসুস্থ মানুষের সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কে বা কারা আমদানি করছে তা খুঁজে বের করতে শুল্ক গোয়েন্দারা কাজ করছেন। আমাদের সন্দেহের তালিকায় কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আছে। শুল্ক গোয়েন্দারা প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছেন। তবে অনলাইনে ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর (বিআইএন) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দেওয়া বন্ধ হবে বলে আশা করছি।’

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি বন্ধ করার লক্ষ্যে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। এনবিআর নজরদারি করছে বলেই বিভিন্ন পণ্য ধরা পড়ছে। সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোনো পণ্য আমদানি করতে দেওয়া হবে না। বিশেষভাবে চিকিৎসাকাজে ব্যবহৃত নিম্নমানের পণ্য আমদানিতে এনবিআর জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/09/13/814082