৫ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ১:২৬

সড়কে নিত্য ট্র্যাজেডি

নিহতের ৫২ শতাংশই পরিবারের অবলম্বন

বাড়তে বাড়তে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই ঝরছে তাজা প্রাণ। অনেকেই হচ্ছেন পঙ্গু। গত শুক্রবার শরীয়তপুরে ট্রাকের চাপায় কলেজের একজন সাবেক অধ্যক্ষ নিহত হন। এছাড়া গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় শিশুসহ পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছে। এ নিয়ে গত ২৩ দিনে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২৩০ জন। বেসরকারি হিসাবে, গত ১০ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় ৪৭ হাজার। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণ হারানো বা পঙ্গুত্ববরণের মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনার ট্র্যাজেডি সীমাবদ্ধ নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৫২ শতাংশই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবার নেমে গেছে ছিন্নমূল বা দারিদ্র্যের কাতারে। বেঁচে থাকার জন্য পরিবারের সদস্যদের আর কোনো অবলম্বন নেই। বেসরকারি সংস্থাগুলো সড়ক দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে কয়েকটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে। কারণগুলো হলো- বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং করার প্রবণতা, চালকদের দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, আনফিট গাড়ি ও থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও সড়কের বেহালদশা। কারণগুলোর সাথে দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য কতিপয় সুপারিশও করা হয়। কিন্তু সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয় না। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই)-এর পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময় ঘটা দুর্ঘটনার স্থান পরিদর্শন ও দুর্ঘটনার ডাটা বিশ্লেষণ করে সরকারের কাছে সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতি মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬ শতাংশের সমান।

সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। বেসরকারি সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানে সড়ক দুর্ঘটনা ও নিহত- আহতের সংখ্যা থাকে বেশি। অপরদিকে, বিআরটিএ বা পুলিশের করা তালিকায় দুর্ঘটনাসহ নিহত-আহতের সংখ্যা থাকে কম। বেসরকারি সংস্থাগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে তালিকা করে থাকে। আর পুলিশ তালিকা করে মামলার ভিত্তিতে। সেই তালিকাই পুলিশের বরাত দিয়ে প্রকাশ করে বিআরটিএ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বছরের হিসাবে বলা হয়, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২১ হাজার ৩১৬ জন। কিন্তু সরকারি হিসাবে ওই বছর নিহত দেখানো হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৫৩৮ জন। সংস্থাটি বলছে, দুর্ঘটনার পর মামলার ভিত্তিতে সরকারের এই সংখ্যা গণনা করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার পর মামলা হয় না। ঘাতক গাড়ির মালিকের সঙ্গে নিহত পরিবার এবং পুলিশের আপসরফার মাধ্যমে সুরাহা করা হয়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, ২০১৪ সালের সারাদেশে ৫ হাজার ৯২৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৮ হাজার ৫৮৯ জন। অথচ বিআরটিএর হিসাবে ওই বছর সারাদেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা ২ হাজার ২৭টি। এতে নিহতের সংখ্যা ২ হাজার ৬৭ এবং আহত ১ হাজার ৫৩৫ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালে সারাদেশে ৬ হাজার ৫৮১ দুর্ঘটনায় নিহত ৮ হাজার ৬৪২ এবং আহত ২১ হাজার ৮৫৫ জন। গত বছর ৪ হাজার ৩১২টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৫৫ জন। আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৯১৪ জন। অথচ বিআরটিএর হিসাবে ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩৯৪টি দুর্ঘটনায় নিহত ২ হাজার ৩৭৬ এবং আহত ১ হাজার ৯৫৮ জন। সরকারি হিসাবে গত বছর জুলাই মাস পর্যন্ত ১ হাজার ৪৮৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১ হাজার ৪২২ জন, আহত ১ হাজার ২৮৯ জন। বেসরকারি হিসাব থেকে সরকারি হিসাবে দুর্ঘটনা, নিহত ও আহতের সংখ্যা অনেক কম। তবে পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেকটাই কম ছিল। বেসরকারি হিসাব মতে, গত বছর দুর্ঘটনা কমার হার ছিল প্রায় ২৩ শতাংশ।

চলতি বছরের শুরু থেকেই সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। বাড়তে বাড়তে এটি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গত মাসে (ফেব্রæয়ারি) দুই দিনে মারা গেছে ৫০ জন। এর মধ্যে একটি গ্রামে ফিরেছে ১২টি লাশ। এক সঙ্গে এত মানুষের প্রাণহানিতে নির্বাক হয়ে পড়েছিল গ্রামবাসী। সড়ক দুর্ঘটনার সেই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। গত ২৩ দিনে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ২৩০ জন। এ হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ১০ জন করে প্রাণ হারাচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার শতকরা ৬৪ ভাগই সংঘটিত হয় গ্রামাঞ্চলের রাস্তাসমূহে। আর শুধু গ্রামের মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। গবেষণায় বলা হয়, মহাসড়কের মাত্র ৪ ভাগ দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাতেই ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত রাস্তার মোড়, পথচারী পারাপারে, বাস স্টপেজে, লেভেল ক্রসিং, শিক্ষা/ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সিনেমা হল এলাকা, হাটবাজার, রাস্তার বাঁক, সেতু/কালভার্ট এলাকা, মিল/কারখানা এলাকায় ঘটে। এছাড়া, ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ। বুয়েটের গবেষণা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার ৪৩ শতাংশই ঘটছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, নিয়ম ভঙ্গ করে ওভারটেক করা এবং নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার চলাচল।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দুর্ঘটনার জন্য প্রধান কয়েকটি কারণ ছাড়াও অতিরিক্ত ১৩টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তা-ঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়ক ও রেল ক্রসিংয়ে ফিডার রোডে যানবাহন উঠে পড়া, বাসের ছাদে ও পণ্যবাহী ট্রাকের উপর যাত্রী বহন ও রাস্তায় ফুটপাথ না থাকা বা ফুটপাথ বেদখলে থাকায় রাস্তার মাঝপথে পথচারীদের যাতায়াত। সংগঠনটি সড়ক দুর্ঘটনারোধে কিছু সুপারিশমালা পেশ করে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবহন মালিক সংগঠনগুলোর কাছে। এর মধ্যে রয়েছে ট্রাফিক আইন ও মোটরযান আইন সম্পর্কে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের, মসজিদ, মন্দির, গির্জায় জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা। টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রসমূহে সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাটবাজার অপসারণ করা, ফুটপাথ দখলমুক্ত করা। রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা। জেব্রা ক্রসিং অঙ্কন করা। চালকদের প্রফেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। চালকদের বিশ্রাম ও কর্মবিরতির সুযোগ দেয়া। বিদ্যমান মোটরযান আইন যুগোপযোগী করা এবং গাড়ির ফিটনেস প্রদান পদ্ধতি ডিজিটাল করা। জাতীয় মহাসড়কে স্বল্প গতি ও দ্রæতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ড. সামছুল হক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে প্রতি বছরের জন্য আলাদা লক্ষ্য ঠিক করে কর্মসূচি নিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের পরিকল্পনা সম্পর্কে আমার জানা নেই। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনারোধে চালক, যাত্রী, পুলিশ, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে।

২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে জাতিসংঘের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ সই করেছে। বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কোন বছর কত সড়ক দুর্ঘটনা কমানো হবে, এর কোনো কর্মপরিকল্পনা এখনো হয়নি। কিছু সড়কের বাঁক সোজা করা এবং মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ছাড়া সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। ১৯৯৬ সালের ব্র্যাকের সুপারিশ করা ১৪৪টি সড়কের বাঁক সোজা করার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় ২০১৫-১৬ সালে। এর মধ্যে বুয়েট আবার নতুন করে আরো ২শ’টি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্পটের তালিকা করেছে। যেগুলোতে প্রায়ই প্রাণ ঝরছে। 

https://www.dailyinqilab.com/article/67790