৯ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৩

যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও খরচ বেশি

সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশের অভিভাবকদের। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা খাতে সরকারের বিনিয়োগ বেশি এবং ওই দেশের নাগরিকদের গড় আয়ও অনেক বেশি। ফলে অভিভাবকদের কম ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারের বিনিয়োগ কম এবং নাগরিকদের গড় আয়ও অপেক্ষাকৃত কম। তার ওপর এ দেশে লেখাপড়া কোচিং ও প্রাইভেট-নির্ভর। ফলে বেশি ব্যয় করতে হয় অভিভাবকদেরই। ফ্রান্সে একটি পরিবারকে সন্তানের শিক্ষার পেছনে মাত্র ১৬ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হয়, বাকিটা দেয় রাষ্ট্র। যুক্তরাজ্যে নার্সারি থেকে ‘এ’ লেভেল পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। ভারতের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও খরচ বাংলাদেশের চেয়ে কম।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিসিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৮ শিক্ষাবছরে অভিভাবকদের মোট খরচের পরিমাণ দাঁড়াবে দুই হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। আর সে দেশে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় কম্পিউটারের পেছনে। প্রত্যেক পরিবার একজন শিক্ষার্থীর পেছনে ওই খাতে মাসে ব্যয় করে ২৯৯ ডলার। এ ছাড়া স্কুলের পোশাকসহ অন্যান্য খাতে খরচ হয় ২৮৬ ডলার। ট্যাবলেট ও ক্যালকুলেটরের মতো ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম কিনতে লাগে ২৭১ ডলার। সবচেয়ে কম অর্থ খরচ হয় ফাইল, ফোল্ডার, বই, হাইলাইটারসহ অন্য সামগ্রী কিনতে। এসবের পেছনে খরচ হয় ১১২ ডলার।

সেই হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে মাসে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে অভিভাবকের ব্যয় হয় ৯৬৮ ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের বছরে গড় আয় ৬০ হাজার ২০০ ডলার অর্থাৎ মাসে পাঁচ হাজার ১৬ ডলার। সেই হিসাবে এক সন্তানের পেছনে অভিভাবকের ব্যয় তার আয়ের ৫.১৮ শতাংশ।

অপরদিকে কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে অভিভাবকের ব্যয় হয় সাত হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থাৎ গড় ব্যয় ১১ হাজার টাকা (প্রায় ১২৭ ডলার)। প্রত্যেক বাংলাদেশির বছরে গড় আয় এক হাজার ৯০০ ডলার অর্থাৎ মাসে ১৫৮ ডলার। সেই হিসাবে প্রত্যেক অভিভাবক তাঁর একেক সন্তানের শিক্ষার পেছনে ব্যয় করেন আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এই ব্যয় ১৫ গুণেরও বেশি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ দেশে শিক্ষা খাতে যথেষ্ট ব্যয় করলেও সমস্যায় পড়তে হয় না উচ্চবিত্ত অভিভাবকদের। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত অভিভাবকরা। তাঁদের আয়ের বড় অংশই চলে যায় সন্তানের লেখাপড়ায়। এতে সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের আয় দেশের নাগরিকদের গড় আয়ের চেয়েও কম। ফলে তারা সন্তানদের পড়াশোনা অনেকটা রাষ্ট্রের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। ফলে নিম্নবিত্ত স্তরের বেশির ভাগ সন্তানই শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে ঝরে পড়ছে। বর্তমানে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার প্রায় ১৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে ৩৯ শতাংশ।

ভারতের দার্জিলিংয়ের জনপ্রিয় স্কুল রকভ্যালি একাডেমির শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে কিংবা কোচিং করতে হয় না। শুধু শিক্ষা উপকরণ কিনতে হয়। ফলে স্কুলের খরচই সেখানে মূল। সেখানে প্রথম শ্রেণির একজন অনাবাসিক শিক্ষার্থীর মাসিক ফি বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার ৫৮৬ টাকা, আর স্কুলের পেছনে বছরে মোট খরচ ২৮ হাজার ৭৯২ টাকা। দশম শ্রেণিতে মাসিক ফি দুই হাজার ৫৬২ টাকা, আর বছরে মোট খরচ ৫৫ হাজার টাকা। দ্বাদশ শ্রেণির মাসিক ফি তিন হাজার ৪১৬ টাকা, আর বছরে মোট খরচ ৭১ হাজার ৪৯২ টাকা। বাংলাদেশ থেকেও অনেক শিক্ষার্থী পড়তে যায় রকভ্যালি একাডেমিতে। ওই স্কুলে প্রথম শ্রেণির আবাসিক শিক্ষার্থীর বছরে মোট খরচ এক লাখ ২৪ হাজার ৪৪০ টাকা। দশম শ্রেণিতে বছরে মোট খরচ এক লাখ ৮০ হাজার ৫৬০ টাকা এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে এক লাখ ৯৮ হাজার ৮৬০ টাকা। তবে নতুন শিক্ষার্থীর ভর্তি হতে লক্ষাধিক টাকা লাগে। তবে ভর্তি ফি শিক্ষাজীবনে একবারই দিতে হয়।

বাংলাদেশের একজন অভিভাবকের এক সন্তান পড়ে এ দেশে, অন্য সন্তান রকভ্যালি একাডেমিতে। নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিভাবক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দার্জিলিংয়ে স্কুলের বেতন বেশি, কিন্তু প্রাইভেট-কোচিংয়ের খরচ নেই। আর বাংলাদেশে স্কুলে বেতন কম হলেও প্রাইভেট-কোচিংয়ে আট-দশ গুণ খরচ। ফলে আমার যে সন্তান দার্জিলিংয়ে পড়ে তার চেয়ে দেশে থাকা সন্তানের পেছনেই বেশি খরচ হয়। এখন আমাদের দেশেও যদি বেতন বাড়িয়ে প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ করা যায়, তা হলেও অভিভাবকদের শিক্ষা ব্যয় অনেকাংশে কমে যাবে।’

ভারতের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও খরচ বাংলাদেশের চেয়ে কম। কলকাতার আদামাস ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে চার বছরে মোট সেমিস্টার ফি বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। আসামের ডাউনটাউন ইউনিভার্সিটিতে চার বছরের ফি প্রায় ছয় লাখ টাকা, গুজরাটের আরআইএমটি ইউনিভার্সিটির কোর্স ফি প্রায় ১০ লাখ টাকা, কলকাতার ব্রেনওয়্যার ইউনিভার্সিটিতে প্রায় সাত লাখ টাকা। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গড়ে চার বছরের কোর্স ফি সাত থেকে আট লাখ টাকা।

‘এইচএসবিসি ও স্যালি মে’-এর সূত্র উল্লেখ করে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, স্কুলের ফি, বইপত্র কেনা, স্কুলে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া সব যোগ করলে প্রাথমিক স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় হংকংয়ে। বৃত্তি, ঋণ, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা এসব বাদ দিলেও একজন শিক্ষার্থীর পেছনে হংকংয়ে একেকজন অভিভাবককে ১২ বছরে নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হয় এক লাখ ৩১ হাজার ১৬১ ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এই ব্যয় ৯৯ হাজার ডলার, সিঙ্গাপুরে ৭১ হাজার ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৫৮ হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে অভিভাবকের পকেট থেকে যায় মোট খরচের ২৩ শতাংশ। আর ফ্রান্সে একটি পরিবারকে সন্তানের শিক্ষার পেছনে মাত্র ১৬ হাজার ডলার পরিশোধ করতে হয়, বাকিটা দেয় রাষ্ট্র।

জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের একজন অভিভাবক সন্তানের পড়াশোনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেন কম্পিউটারের পেছনে। অপরদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, এ দেশের অভিভাবকরা সন্তানের পড়াশোনায় সর্বাধিক ব্যয় করেন প্রাইভেট ও কোচিংয়ের পেছনে, যা মোট শিক্ষা ব্যয়ের ২৯ শতাংশ। ফলে অন্যান্য দেশে পড়াশোনার পাশাপাশি দক্ষতা নিয়ে বেড়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। আর বাংলাদেশে বেড়ে উঠছে মুখস্থবিদ্যায় ভর করে, যা কর্মক্ষেত্রে তেমন একটা কাজে আসছে না।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আতাউর রহমান বলেন, ‘প্রতিটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৮০ জনের ওপরে। নানা কারণে বছরের অর্ধেক সময়ই স্কুল বন্ধ থাকে। যতটুকু সময় খোলা থাকে সে সময়েও ক্লাসে তেমন একটা পড়ালেখা হয় না। শিক্ষকরাও প্রাইভেট-কোচিংয়ে যেতে উৎসাহ দেন। প্রতিটি বিষয়ে নোট-গাইডও কিনতে হয়। ফলে অন্যান্য খাতে ব্যয় কমিয়ে হলেও সন্তানের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করতে হয়।’

রাজধানীর কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ বলেন, ‘অধিকাংশ শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ পাঠদান করেন না। দেখা যায়, ক্লাস সময়ের বাইরে তিনি সময় দেন না। আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বেশি। ফলে সব শিক্ষার্থী পড়া ঠিকমতো ধরতে পারে না। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি স্কুল-কলেজেই ডাবল শিফটের কারণে শিক্ষকরা খুব বেশি সময় দিতে পারেন না শিক্ষার্থীদের। বইয়েও ত্রুটি আছে। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট-কোচিংয়ে যেতে হয়। তবে বেসরকারি শিক্ষকরা পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা পান না বলেই প্রাইভেট পড়ান বলে প্রচলিত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার পাল্টা প্রশ্ন, সরকারি শিক্ষকরা তাহলে কেন প্রাইভেট পড়ান?’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিভিন্ন স্কুল বাধ্য করছে প্রাইভেট-কোচিং করতে, গাইড কিনতে। আমাদের দেশের শিক্ষা কাঠামো যেহেতু পরীক্ষানির্ভর, তাই অভিভাবকরা প্রাইভেট-কোচিংয়ের পেছনে ছুটছেন। এতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এখন প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও বেতন বাড়িয়ে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষকরা যদি সচ্ছলভাবে চলার নিশ্চয়তা পান তাহলে স্কুলেই বেশি জোর দেবেন। অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সরকারের পরিকল্পনা সাজাতে হবে।’

যুক্তরাজ্যে নার্সারি থেকে ‘এ’ লেভেল পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে : জানা যায়, যুক্তরাজ্যে নার্সারি থেকে ‘এ’ লেভেল পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। সেখানে সরকারি প্রাথমিক স্তরে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য বছরে ১৫ হাজার পাউন্ড এবং মাধ্যমিক স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য ব্যয় করা হয় ২২ হাজার পাউন্ড। তবে সরকার ওই অর্থ দেয় সংশ্লিষ্ট এডুকেশন অথরিটিকে। তারা সংশ্লিষ্ট স্কুলে ওই অর্থ থেকেই শিক্ষকদের বেতন, শিক্ষা উপকরণ, বই, যাতায়াতসহ নানা খাতে খরচ করে। সেখানকার শিক্ষার্থীরা গাইড বই পড়লেও তা স্কুল থেকেই কিনতে হয়, সেটা বাড়িতেও নেওয়া যায় না। কোনো কোনো শিক্ষার্থী প্রাইভেট শিক্ষকেরও দারস্থ হয়। সে জন্য প্রতি বিষয়ে প্রতি ঘণ্টায় ২০ থেকে ৫০ পাউন্ড লাগে।

তবে ইংল্যান্ডে ৭ শতাংশ প্রাইভেট স্কুল আছে, যেখানে পড়াতে অভিভাবকদের খরচ করতে হয়। ভালো প্রাইভেট স্কুলে বার্ষিক ফি ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার পাউন্ড। আর আবাসিক শিক্ষার্থীর জন্য আরো ১০ হাজার পাউন্ড খরচ করতে হয়।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2019/05/09/767398