২ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:২৩

ভয়ঙ্কর আবিষ্কার ‘বিএনপি-জামায়াত’!

‘নিজের দু’টি চরণ ঢাকো তবে/ ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় মানুষকে এই পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সে পরামর্শ গ্রহণ না করে ক্ষমতাসীনরা কারণে-অকারণে সব অপকর্মের মধ্যে আবিষ্কার করছেন ‘জামায়াত-বিএনপি’ নাম। বৃদ্ধের কথায় জুতা আবিষ্কার করায় রাজা ধুলো থেকে মুক্তি পেয়েছেন বটে; কিন্তু প্রতিটি অঘটনের পিছনে বিএনপি-জামায়াতের হাত ‘আবিষ্কার’ করে সরকার দেশবাসীকে কি বার্তা দিচ্ছেন?

দেশের কোথাও অপ্রীতিক অঘটন ঘটলেই অভিযোগ তোলা হয় ওটা জামায়াত-বিএনপির কর্ম। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মনের ক্রিয়াকর্মে যেন ‘জামায়াত-বিএনপি’ নাম খোদাই করাই রয়েছে। কিছু হলেই ঘটনার গভীরে না গিয়ে ‘জামায়াত বিএনপির দিকে আঙ্গুল তোলা হয়। হত্যাকান্ড হোক, চুরি-ডাকাতি হোক, দুর্ঘটনা হোক, দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল হোক; এমনকি বিদেশিরা সরকারের ওপর চাপ দিলেও সে জন্য দায়ী করা হয় জামায়াত-বিএনপিকে।

হঠাৎ পরিবহন ধর্মঘটে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের জনজীবনের চরম ভোগান্তি নেমে আসে। নৌমন্ত্রী শাহজাহান খানের সরকারি বাসায় বসে পরিবহন শ্রমিক-মালিকরা ধর্মঘট করার ঘোষণা দেন। মন্ত্রীর বাসায় পরিবহন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হলে সরকারের অবস্থান কোথায়! পরিবহন ধর্মঘটের প্রথম দিন পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় ব্যপক ভাঙচুর, অরাজকতা ধ্বংসযজ্ঞ হয়। দ্বিতীয় দিন গাবতলীতে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে একজনের প্রাণহানি ঘটে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া পরিবহন শ্রমিকদের অনৈতিক ধর্মঘটের সমর্থন জানান নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান। শুধু কি তাই! মহামান্য প্রেসিডেন্টের কাছে শপথ নেয়া মন্ত্রীদের ‘রাগ বিরাগের বশবতী’ হওয়ার সুযোগ নেই।

শ্রমিকদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে শাজাহান খান বলেন, ‘বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাজপথে কর্মসূচি দিতেই পারে’। এটা কি শপথ ভঙ্গ নয়? অথচ শ্রমিকদের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি চলার সময় যখন ব্যপক ধ্বংসযজ্ঞ হয় তখন মন্ত্রী শাহজাহান খান বলেন ‘পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে জামায়াত-বিএনপি ঢুকে গেছে’। আওয়ামী লীগের আরো কয়েকজন নেতা এবং এমপি পরিবহন ধর্মঘটে শ্রমিকদের ভিতরে বিএনপি-জামায়াত ঢুকে ধ্বংসযজ্ঞ করছে এমন অভিযোগ তোলেন। মন্ত্রীর বাসায় সিদ্ধান্তের কর্মসূচি পালনে যদি জামায়াত-বিএনপি ঢুকে যায় তাহলে মন্ত্রীর অবস্থান কোথায়? নাকি মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীনদের মননে জামায়াত-শিবির-বিএনপি ‘মেনিয়া’ পেয়ে বসেছে?

‘মন’ একটি শব্দ। মস্তিষ্কের প্রতিমুহূর্তের ক্রিয়াকর্মের সুসংগঠিত সামষ্টিক অবস্থাই হলো মন। এর মাধ্যমে মানুষের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তা, কল্পনা, স্মৃতি, আবেগের সৃষ্টি হয়। মানুষ বিভিন্ন তথ্য উপাত্তকে যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মানুষের শরীর যেমন অসুস্থ হয়, মনও তেমনি অসুস্থ হতে পারে। মেনিয়া এবং বিষণœতা গুরুতর মানসিক রোগ। দুঃচিন্তা, অহেতুক ভয়, সুচিবাই লঘুতর মানসিক রোগ। শাজাহান খানসহ ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, নেতারা কোন রোগে আক্রান্ত? অঘটন ঘটলেই তারা ঘটনার নেপথ্যে জামায়াত-বিএনপির সম্পৃক্তরা আবিষ্কার করেন।

নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতেই কি তারা জামায়াত-বিএনপি মেনিয়া রোগে আক্রান্ত! মনন ও মানসিকতায় কি তারা এটা ধারণ করছেন? বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ শ্রমিক লীগের এক সমাবেশে ইনসুর আলী নামে শ্রমিক নেতা বলেছেন, শাহজাহান খানদের ধর্মঘটে বিএনপি জামায়াকের সমর্থক শ্রমিকরা ভাঙচুর ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাচ্ছে। গাবতলীর সহিংস ঘটনার জন্য আসলামুল হক আসলাম নামের এক এমপি শ্রমিক ধর্মঘটে ভাঙচুরের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন। প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বলেন, শ্রমিক ধর্মঘটে ‘অঘটনের পিছনে’ বিএনপি দায়ী।

ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিতে দেশের সব অপকর্মের মধ্যেই ‘বিএনপি-জামায়াত’ আবিষ্কার হচ্ছে। যুবক দর্জি বিশ্বজিতকে দিনে-দুপুরে পুরান ঢাকায় পুলিশের সামনে ছাত্রলীগ নেতারা হত্যা করলে সেখানে বিএনপি জামায়াত-শিবির-ছাত্রদল ‘আবিষ্কার’ করা হয়। সরকারের শীর্ষমহল থেকে ঘোষণা দেয়া হয় ছাত্রলীগের ভিতরে এসে ছাত্রদল শিবির এই হত্যাকান্ড ঘটেছে। অতপর বলা হয় ঘাতকদের পরিবারের সদস্যরা বিএনপির সঙ্গে যুক্ত। ওরা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছে। তদন্তের পর দেখা গেল হত্যাযজ্ঞের নায়ক ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

আদালত তাদের কারো ফাঁসি কারো যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। গাইবান্ধা-১ আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকান্ডের পর সরকারের শীর্ষমহল থেকে শুরু করে মন্ত্রী এমপিরা আবিষ্কার করেন ঘটনার জন্য দায়ী জামায়াত-বিএনপি। কর্পারেট হাউজের মালিকানাধীন ক্ষমতাসীন দলের তল্পিবাহক মিডিয়াগুলোয় নিত্যদিন জামায়াত শিবির ও বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয়। পুলিশ জামায়াত, শিবির ও বিএনপির শত শত নেতাকে গ্রেফতার করে। ‘বাণিজ্য’ করে কাউকে থানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়; আবার কাউকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। গ্রেফতারের ভয়ে পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে সুন্দরগঞ্জের কয়েকটি গ্রাম। লিটন হত্যার পর গ্রেফতার হওয়া প্রায় দেড়শ ব্যক্তি এখনো কারাগারে। অথচ গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি কর্নেল (অব) কাদের খান হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

পুলিশ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দীর্ঘ প্রচেষ্টার মাধ্যমে লিটন হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের গ্রামে অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির ওপর দায় চাপানো হয়। একদিন পর ক্ষমতাসীন দলের একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন ওই দলের এক এমপি। পরে দেখা গেল ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে নিরীহ সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। গ্রেফতার করা হয় আওয়ামী লীগের নেতাদের। গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লীতে অগ্নিসংযোগের পর প্রথমে বিএনপি-জামায়াতের ওপর দায় চাপানো হয়। দুদিন পর সাঁওতালদের বিরুদ্ধেই নিজেদের ঘরে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ তোলা হয়।

এক সাপ্তাহ পর কাতার থেকে প্রচারিত আল জাজিরা টিভির সচিত্র খবরে দেখা গেল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দু’জন সদস্য স্থানীয় আওয়ামী লীগে নেতার সহায়তায় সাঁওতালদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করছেন। পাশে পুলিশের গাড়ি। ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়ায় জাপানি নাগরিক হোশিও কোনিও হত্যাকান্ডের পর বিশ্ব মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা পায়। তখন সরকারি দল থেকে বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা এবং তার ভাইসহ কয়েকজনকে হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী আবিষ্কার করা হয়। এ নিয়ে প্রচারণা চলে দেশি বিদেশি মিডিয়ায়। কিন্তু পরে দেখা গেল বিএনপি নেতার সঙ্গে ওই হত্যকান্ডের কোনো যোগসূত্রই নেই। গত মঙ্গলবার মামলার রায়ে যে ৫ জনের ফাঁসি দেয়া হয় তারা সবাই জেএমবি নেতা। ২০১৫ সালেই ঢাকার গুলশানে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার খুন হন। সে ঘটনার জন্য বিএনপির নেতা জড়িত আবিষ্কার করা হয়। বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতাকে হুকুমদাতা ‘বড় ভাই’ হিসেবে প্রচার করা হয়।

দেশি বিদেশি চক্রান্তে গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে ষড়যন্ত্র এবং শ্রমিক অসন্তোষে আন্দোলন হলেই ঘটনার জন্য বিএনপি জামায়াতকে দায়ী করা হয়। অথচ প্রকৃত চিত্র খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করে না সরকার। যুবলীগ নেতা রানার মালিকানাধীন সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসের পর প্রথমেই অভিযোগ তোলা হয় বিএনপির নেতারা ধাক্কাধাক্কি করে বিল্ডিং ভেঙে ফেলেছে। ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর সরাসরি এ অভিযোগ তোলেন। পরের ঘটনা সবার জানা।

আমেরিকা জিএসপি সুবিধা স্থগিত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি সুবিধা বন্ধের উপক্রম, বিদেশে শ্রমিক নিয়োগে স্থবিরতা, মিলকারখানার উৎপাদন কমে যাওয়া, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য জাতিসংঘ, দাতা সংস্থা ও বিদেশিদের অব্যাহত চাপের মধ্যেও ক্ষমতাসীনরা বিএনপি-জামায়াতের হাত আবিষ্কার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গ্রুপিং লবিং এ সংঘর্ষ, বন্দুকযুদ্ধ এবং হিংসাত্মক ঘটনায় অর্ধশত নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছে।

প্রতিটি ঘটনার পর প্রথমেই ক্ষমতাসীন দল থেকে অভিযোগ তোলা হয় ছাত্রলীগের ভিতরে জামায়াতের ছাত্রশিবির ও বিএনপির ছাত্রদল অনুপ্রবেশ করেছে। তারাই এসব অপকর্ম করছে। এমনকি চট্টগ্রামে পুলিশের এসপি বাবুলের স্ত্রী খুন এবং কুমিল্লায় সোহাগী জাহান তনু হত্যাকান্ডের পরও প্রথমে বিএনপি-জামায়াতের হাত ‘আবিষ্কার’ করা হয়। পরে অবশ্য ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। গত বছরের শেষ দিকে ফ্রান্সের একটি স্কুলে গাড়ি বোমা হামলায় কয়েকজন নিহতের পর আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদ দাবি করেন ফ্রান্সের ওই ঘটনার পিছনে বিএনপির হাত রয়েছে। জাসদের একজন মন্ত্রীতো বিএনপি নেত্রীকে আইএস নেত্রী বলতে অভ্যস্ত। বিশ্বব্যাংক যে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়, তার পিছনে প্রথমে বিএনপির হাত আবিষ্কার করেন ক্ষমতাসীনরা। পরে অবশ্য এ জন্য দায়ী করা হয় নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসকে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে রাস্তাঘাটে বাস দুর্ঘটনা, নদীতে লঞ্চ ডুবি, ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হলেও ঘটনার পিছনে বিএনপির হাত রয়েছে আবিষ্কার করা হয়। অবশ্য নৌমন্ত্রী শাহাজাহান খানের ‘গরু-ছাগল চিনলে ড্রাইভারদের লাইন্সেস দেয়ার নির্দেশ’ আরটিভির লাইভ টকশোতে ‘বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার চোখ তুলে নেয়ার হুমকির নেপথ্যে বিএনপির হাত আবিষ্কার করা হয়নি। এই রক্ষা।

https://www.dailyinqilab.com/article/67267